Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Monday, December 12, 2016

পুতুলের বিয়ে

পুতুলের বিয়ে


(পুতুল খেলিতে খেলিতে মেয়েদের গান)


  


খেলি আয় পুতুল-খেলা


বয়ে যায় খেলার বেলা সই।


বাবা ওই যান আপিসে ভাবনা কীসের,


খোকারা দোলায় ঘুমায় ওই॥


দাদা যায় ইস্কুলেতে, মা খুড়িমা


রান্না করেন ওই হেঁশেলে,


ঠানদি দাওয়ায় ঝিমোয় বসে


ফোকলা বদন মেলে।


আয় লো ভুলি পঞ্চি টুলি


পটলি খেঁদি কই॥


  



কমলি।

তা হলে ভাই টুলি, তোকে আর টুলি বলব না। তুই আজ থেকে আমার বেয়ান হলি, কেমন? আজ যে আমার চিনে পুতুলের সঙ্গে তোর মেম-পুতুলের বিয়ে।



টুলি।

না ভাই কমলি, তোর ওই কদা-কুচ্ছিত চিনে পুতুলটার সঙ্গে আমার মেম-পুতুলের বিয়ে দেব না। বাবা! তোর ওই পুতুলটা যা চোখ উলটোয়! আমার পুতুল ওকে দেখলে ভয়ে আঁতকে উঠবে! তার চেয়ে –তোর ওই পুতুলটি, যার নাম রেখেছিস ডালিমকুমার – ওইটিকে আমি জামাই করব।



কমলি।

মা গো কী হবে! তাহলে আমার চিনে পুতুলের বিয়ে হবে কী করে? ওকে যে কেউ বিয়ে করতে চায় না! অত বড়ো ছেলে আমার আইবুড়ো ওকে যে কেউ বিয়ে করতে যায় না! অত বড়ো ছেলে আমার আইবুড়ো হয়ে থাকবে? মা গো, লোকে বলবে কী!



টুলি।

তা ভাই, তুই বরং পঞ্চির মেয়ের সঙ্গে ওর সম্বন্ধ কর না!



পঞ্চি।

কী কস! পঞ্চির বেডি অত হস্তা না! ওই চিনা অলম্বুসডারে জামাই করব নি! ওডা দেখবার যেমন ভূতের লাহান, নামও তেমনই রাখছে–ফুচুং! উয়ারে দেইহাই আমার মায়্যা এক্কুরে চিক্কুর পাইর‌্যা ফাল দিয়া উঠব! আপন বেডির দেয় না ক্যান?



টুলি।

বাপরে, ওকে আর খ্যাপাসনে ভাই! তার চেয়ে বরং বাঁকড়ি খেঁদিকে বলে দেখ, সে যদি মেয়ে দিতে রাজি হয়!



খেঁদি।

বটে! সে হবেক নাই ভাই! আমার বিটিকে বিষ খাওঁয়াই মেরে ফেলব,তবু উ চিনাটাকে বিয়া দিব নাই! টুলি একটা চিনা মেয়্যা আনা করাক, উয়ার সঙ্গে তখন ওই চিনা পুতুলের বিয়া দিবেক।



কমলি।

না ভাই, তোরা সব আমার খোকাকে অমন করে যা-না তাই বলিস নে! খোকা একটু খ্যাঁদা আর চোখ একটু কুতুরে বলেই না তোরা ওকে চিনা মনে করিস! ও কি আর সত্যিই চিনে? ওকে তো আমিই পেটে ধরেছি! ওই দ্যাখই ও বুঝি কাঁদছে। ষাট, ষাট, বালাই!–


  


ধন ধন ধন ধন মুরলি


এই ধনকে দেখতে নারে কোন বেড়ালি!


ওকে কে বলে রে খ্যাঁদা,


তার চোখে লাগুক ধাঁদা।


খ্যাঁদা কি বলতে দেব?


সোনা দিয়ে নাক বাঁধিয়ে দেব॥


  



টুলি।

তাহলে ভাই, ডালিমকুমারের সঙ্গেই আমার মেয়ের সম্বন্ধ পাকা হল, কেমন?



কমলি।

আচ্ছা ভাই, তাই নয়তো হল! তোর পুতুলের নাম কী ভাই? পুঁটুরানি, না? দে, বউকে একটু নাচাই।


  


পুঁটু নাচে কোনখানে


শতদলের মাঝখানে।


সেথায় পুঁটু কী করে,


ডুব-গালিগালি মাছ ধরে।


মাছ ধরে আর ফুল পাড়ে


কুঁড়োজালি দিয়ে মাছ ধরে॥



খেঁদি।

এই! বিয়া যে দিবি, নেমন্তন্ন করতে বেরাবি নাই? ইদিকে ম্যাঘে ম্যাঘে যে এনেক বেলা হঁয়ে গেল খ।



কমলি।

খ ঠিক বলেছে ভাই খ! না ভাই সত্যি, চল – পটলিকে আর বেগমকে নিয়ে আসি।



টুলি।

ওই দেখ, বেগম আসছে। – হ্যাঁ, দেখ কমলি, বেগমের সুন্দর একটা জাপানি পুতুল আছে, ওইটের সঙ্গে তোর চিনে পুতুলের বিয়ে দে না!



কমলি।

বেশ মনে করিয়ে দিয়েছিস ভাই। সেই – কী যেন একটা ছড়া আছে-ছাই মনেও পড়ছে না!



টুলি।

ও! সেই ছড়াটা তো? –


  


 খুকুর দেব বিয়ে বেগম-মহলে,


 খুকু হবে বেগম সাহেব, বাঁদি সকলে।


 খুকু হাতে পড়বে হিরের বালা


 গলায় পরবে মুক্তোর মালা।


সোনার খাটে থাকবে শুয়ে রুপোর মহলে


শতেক বাঁদি বাঁধবে চুল নাইয়ে গোলাব-জলে॥


  


[গান করিতে করিতে বেগমের আগমন]


 কুলের আচার নাচার হয়ে


 আছিস কেন শিকায় ঝুলে।


 কাচের জারে বেচারা তুই


 মরিস কেন ফেঁপে ফুলে॥


 কাঁচা তেঁতুল পেয়ারা আম


ডাঁশা জামরুল আর গোলাব-জাম –


 যেমনি তোরে দেখিলাম


অমনি সব গেলাম ভুলে।



কমলি।

আয় ভাই বেগম, তুই আজ এত দেরি করলি কেন ভাই?



বেগম।

বাপরে! আব্বা যা বকেন ভাই, আমি বাইরে বেরুলে। আহ্মাকে বলেন আমাকে পর্দার ভিতর বিবি করে রাখতে।



কমলি।

মা গো মা! কী হবে! অসৈরণ সইতে নারি! আট বছরের মেয়ে আবার বিবি হবে। যা না তাই! তোর সেই ছড়াটা। কীরে বেগম?



বেগম।

ও! সেইটে?


  


মা গো মা,


আমি বিবি হব না।


আম কুড়োব, জাম কুড়োব, কুড়োব শুকনো পাতা,


সোয়ামি করবে লাঙল-চাষ, আমি ধরব ছাতা।


  



টুলি।

এই বেগম, শুনছিস! আমার মেম-পুতুলের সাথে কমলির ডালিমকুমারের আজ বিয়ে।



বেগম।

সে কী ভাই। কমলির ডালিমকুমার যে আমার জামাই হবে বলে কথা দিয়েছিল। আমার জাপানি পুতুলের কী হবে তাহলে?



কমলি।

তা ভাই, কী করি বল। তোরা সবাই চাস ডালিমকুমারকে জামাই করতে। ও বেচারা ছেলেমানুষ, কটা বউ সামলাবে বল তো! তাতে আবার বিবি বউ! বউগুলো আমার ছেলের হাড় সেদ্ধ করে দেবে যে!



বেগম।

তা আমি জানিনে ভাই! টুলি তো ফুচুংকে জামাই করবে, কথা ছিল। আমার গেইসা পুতুল কি তাহলে কড়ে রাঁড়ি হয়ে থাকবে?



পঞ্চি।

কমলি রে বোনডি! তোর পোলারে দুইটা মায়্যার সাথেই বিয়া দিয়া দে।



কমলি।

তা ভাই ও মন্দ বলেনি। আমার ডালিমকুমার তোদের দুজনার মেয়েকেই বিয়ে করুক। সে বেশ হবে। এক বউ শুয়ে থাকবে আর এক বউ মশা তাড়াবে।



টুলি।

কী? আমার মেয়ে সতিন নিয়ে ঘর করবে? আমি বেঁচে থাকতে নয়! আয় পুঁটু, তোর অন্য বর খুঁজি গে।



পঞ্চি।

বাপপুরে! তোমার পুথুলটা যেন হক্কল বুঝবার পারছে। পুথুল, তার আবার হতিন!



টুলি।

তুই বুঝবি কি লা? হতিস মেয়ের মা, তাহলে বুঝতিস! পুঁটু, বল তো মা সেই ছড়াটা।—


  


আয়না আয়না আয়না


সতিন যেন হয়না।


উদবেড়ালি খুদ খায়


স্বামী রেখে সতিন খায়।


  খ্যাংরা খ্যাংরা খ্যাংরা


সতিনের মাথায় যেন হয় উকুন আর ড্যংরা।


বেড়ি বেড়ি বেড়ি


  সতিন আবাগি চেড়ি!


খোরা খোরা খোরা


সতিনকে ধরে নিয়ে যায় যেন তিন মিনসে গোরা।


হাতা হাতা হাতা


খাই সতিনের মাথা।


থুত কুড়ি থুত কুড়ি থুত কুড়ি


  সতিন যেন হয় আঁটকুড়ি।


পাখি পাখি পাখি


নীচে মলো সতিন আমি উপর থেকে দেখি।


ফুলগাছটি ঝিঁকুড়ি


  সতিন আবাগি মেকুড়ি।


ঢেঁকিশালে শুলো আর ঠুস করে মলো।


বঁটি বঁটি বঁটি


সতিনের ছেরাদ্দের কুটনো কুটি।


   অশথ কেটে বসত করি


  সতিন কেটে আলতা পরি।



খেঁদি।

এতও জানে খ! ছড়ায় ছড়ায় ছিরকুটে দিলেক।



বেগম।

নে ভাই, আর ঝগড়া করতে হবে না। আমি ওই ফুচুং-এর সাথেই গেঁইস পুতুলের বিয়ে দেব।



টুলি।

আঃ, তুই বাঁচালি ভাই বেগম। ধনে পুত্রে লক্ষ্মীলাভ হোক তোর।



কমলি।

নে ভাই, এইবার লগ্নের ব্যবস্থা দেখি। এখন যে একজন পুরুত ঠাকুরের দরকার। পাঁজি পুথি দেখবে কে?



টুলি।

হাঁ ভাই, বেশ মনে করেছিস। আমাদের বাড়িতে পুরুত ঠাকুর এসেছেন। মায়ের কী ব্রত আছে। আমি গিয়ে বুড়োকে ধরে আনি।



বেগম।

সব তো হল ভাই, আমার মেয়ের কপালেই ওই চোখ উলটানো চিনে পুতুলটা ছিল।



পঞ্চি।

আরে যাইতে দে! পুথুলের তো বিয়া! ওই চিনাডার সাথেই তোর জাপানি ম্যায়াটার বিয়া দে। আর কাইজ্যা করে না! দেহি রে কমলি, তোর চিনা পুতুলডারে দেহি। মাইয়্যো গো, উয়ার চেহারাডা দেইহ্যা আমার একটা ছরাগান মনে আইছে! —


  


ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়


যাইতে যাইতে খ্যাচখ্যাচায়।


প্যাঁচায় গিয়া উঠল গাছ,


কাওয়ারা সব লইল পাছ।


প্যাঁচার ভাইশতা কোলা ব্যাং


কইল, চাচা দাও মোর ঠ্যাং।


প্যাঁচায় কয়, বাপ, বারিত যাও


পাছ লইছে সব হাপের ছাও।


ইঁদুর জবাই কইর্যা খায়


বোঁচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়॥


    (সকলের হাসি)


  



বেগম।

না ভাই। জামাইয়ের যা কেচ্ছা করছে, আমি ওর সাথে মেয়ের বিয়ে দেব না।



খেঁদি।

লে ভাই, তুরা যদি ঝগড়াই করবি, বিয়া হবেক কখন? ইদিকে লগনের বেলা যে বয়ে গেল! আচ্ছা ভাই, মুসলমানের পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়া হবেক কী করে খ।



কমলি।

না ভাই, ও কথা বলিসনে। বাব বলেছেন, হিন্দু মুসলমান সব সমান। অন্য ধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন। ওদের আল্লাও যা, আমাদের ভগবানও তা। বাবা আমাকে একটা গান শিখিয়েছিলেন, টুলি, তুইও তো জানিস ও গানটা, গা না ভাই আমার সাথে।


(গান)


    মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।


    মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥


    এক সে আকাশ-মায়ের কোলে


    যেন রবি শশী দোলে,


এক রক্তে বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান॥


এক সে দেশের খাই গো হাওয়া এক সে দেশের জল,


এক সে মায়ের বক্ষে ফলে এক সে ফুল ও ফল।


    এক সে দেশের মাটিতে পাই


    কেউ গোরে, কেউ শ্মশানে ঠাঁই।


এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান।


  



টুলি।

সত্যি ভাই, এক দেশে জন্ম, এক মায়ের সন্তান। অন্য ধর্ম বলে কি তাকে ঘেন্না করতে হবে? -এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে - আমি পুরুত ঠাকুরকে ডেকে আনি।



কমলি।

শিগগির আসবি কিন্তু ভাই। দাদা এলে কিন্তু সব তচনচ করে দেবে।


  


[গান করিতে করিতে কমলির দাদা মণির আগমণ]


  


(গান)


  


হেড মাস্টারের ছড়ি, সেকেন্ড মাস্টারের দাড়ি।


থর্ড মাস্টারের টেড়ি, কারে দেখি কারে ছাড়ি।


হেড-পণ্ডিতের টিকির সাথে ওদের যেন আড়ি॥


দাঁড়াইয়া ওই হাই বেঞ্চে


হাসি রে মুখ ভেংচে ভেংচে,


খোঁড়া সেকেন্ড পন্ডিত যায় লেংচে


 হুঁকো হাতে বাড়ি,


তার মুখ নয় তোলো হাঁড়ি,


মোর হেসে ছিঁড়ে যায় নাড়ি॥



মণি।

এই কমলি, কী হচ্ছে? ওরে বাপরে! কী সুন্দর সুন্দর সব পুতুল বের করা হয়েছে। দেখি, দেখি তোর পুতুল। আহা, ভাগ্নে আমার! এসো এসো, একটু আদর করি!



কমলি।

ওই যাঃ! আমার সায়েব পুতুলের ঠ্যাং ছিঁড়ে দিলে! হেই দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, লক্ষ্মীটি, -আজ যে আমার পুতুলের বিয়ে। তোমাকে খুব করে খেতে দেব, মা কালীর দিব্যি করে বলছি।



মণি।

হুঁম! মাস্টার মশাইয়ের মার খেয়ে আজ খিদেটা বেশি রকমেরই হয়েছে! দে, তবে নিয়ে আয় খাবার।



কমলি।

ও মা, এখুনি খাবার কী! টুলি পুরুতকে ডাকতে গেছে, পুরুত ঠাকুর আসুন, বিয়ে হোক, তারপর না খাবার!



মণি।

আরে, পুরুত ঠাকুর আবার কী মন্ত্র পড়াবে? দে, আমিই মন্ত্র পড়াচ্ছি—


  


আশীর্বাদং শিরশ্ছেদং ধ্বংস নাশং


অষ্টাঙ্গে ধবল কুষ্টিং পুড়ে মরং।


  



খেঁদি।

মা গো কী হবে! এই নাকি মন্তর হল খ!



মণি।

এই বাঁকড়ি খেঁদি, চুপ কর বলছি, নইলে তোর দাদাকে সুদ্ধু ডেকে আনব, মজাটা টের পাবি তখন!



বেগম।

দোহাইও মণিদা, ওকে আর ডাকতে হবে না! বাপরে, একা রামে রক্ষে নেই, তাতে আবার সুগ্রীব দোসর।



মণি।

এই যে, বেগম! তুই কি খাওয়াবি? পোলাও মাংস কিন্তু। নইলে তোর মেয়ের নাড়ি ভুঁড়ি বের করে দেব, একেবারে হিরণ্যকশিপু বধ!



কমলি।

রক্ষে করুন ঠাকুর, আমরা কি হনুমান যে, চাল-কলার লোভ দেখাচ্ছেন! এখন পাঁজি-পুথি বের করে বিয়ের লগ্ন দেখুন।



মণি।

পুরুত ঠাকুরের টিকিটি কী সুন্দর! যেন পারে যাবার টিকিট! আগাউ আবার জবা ফুল বাঁধা, যেন কুঁকড়ো ঝুলছে!



পুরুত।

আরে রামঃ রামঃ! এ লক্ষ্মীছাড়াটা কোত্থেকে জুটল? না দিদি ঠাকুরুন, আমার আর মন্ত্র পড়া হবে না। যা হনুমান জুটিয়েছ, ও চাল-কলা তো খাবেই, উলটে জাত-ধর্ম পর্যন্ত নষ্ট করে দেবে!



মণি।

ঠাকুর মশাই, ঠাকুর মশাই! আপনার চট্টোপাধ্যায় মশাই যে বঙ্কিম হয়ে চাতক পক্ষীর মতো হাঁ করে আছেন! বাবা, চটি তো নয় যেন জাঁতি-কল ওটা কী? গামছা? ওটা গামছা তো নয়, গাম ধাড়ি!



কমলি।

আঃ, কী হচ্ছে দাদা? না পুরুত মশাই, আপনি রাগ করবেন না। আপনি এখন দিন দেখুন।



পুরুত।

হুঁ, বর কনেকে নিয়ে এসো, যোটক মিলিয়ে দেখি। বাঃ বাঃ! চমৎকার বর-কনে। এদের নাম কী?



কমলি।

বরের নাম ডালিমকুমার, কনের নাম পুঁটুরানি।



টুলি।

আর একজোড়া বর কনে আছে পুরুত ঠাকুর! বরের নাম ফুচুং আর কনের নাম গেঁইসা।



পুরুত।

এরকম নাম তো সনাতন ধর্মে শোনা যায় না!



টুলি।

হাঁ ঠাকুর মশাই, বর হচ্ছে চিনে, আর কনে হচ্ছে জাপানি।



পুরুত।

তা হলে ওই কমলির দাদাই ওদের পুরুত হোক। ও সব যাবনিক অনুষ্ঠান আমার জানা নেই।



মণি।

বেশ, বেশ! এই কমলি শিগগির তুই তা হলে এক ঝুড়ি আরশুলো, গোটা দুই টিকটিকি, তিনটে সোনা ব্যাং, পোয়াখানিক কেঁচো, এক ডজন পচা ডিম আর খানিকটা নাপ্পি জোগাড় করে আন, বুঝলি? ভোজ হবে!



পঞ্চি।

দ্যাহো দাদা, এইদুন এক চটকনা লাগাইমু যে উৎকা মাইর‍্যা পইর‍্যা যাইব্যা! ওয়াক থুঃ! এ কী কয়, আমার বমি আইতেছে!



মণি।

আরে, আরশোলার কাবাব, টিকটিকির চাটনি, পচা ডিম ঘন্ট, তারপর এই-কোলাব্যাঙের কাটলেট, এ সব না হলে চিনেদের ভোজ হবে কী করে? আর, বেগম! তোরা তো ঈদের সময় সেমাই খাস, কেঁচো দিয়ে কী চমৎকার চিনে সেমাই হবে।



বেগম।

তৌবা, তৌবা। মণি দাদা, তুমি ভয়ানক দুষ্টু! পেটের ভাত পর্যন্ত উঠে আসছে!



পুরুত।

হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ! টুলি, তুই ডেকে এনে আমার এই সর্বনাশটা করলি! আবার গঙ্গাস্নান করতে হবে দেখছি!



মণি।

তা তো হবে, কিন্তু ঠাকুর মশাই, এখানে গো-বর তো পাওয়া যায় না, খানিকটা নর-বর এনে দেব?



কমলি।

দাদা, আমি চললাম মাকে ডাকতে। এখনই টের পাবে মজা!



মণি।

আচ্ছা ভাই, এই আমি চুপ করলাম। এক ঘন্টার মধ্যে কিন্তু সন্দেশ রসগোল্লা চাই।



টুলি।

এইবার ঠাকুর মশাই লগ্ন ক্ষণ দেখুন না।



পুরুত।

আর দশ মিনিটের মধ্যে কিন্তু লগ্ন, সব প্রস্তুত তো?



কমলি।

হাঁ সব প্রস্তুত। আমরা ততক্ষণ একটা বিয়ের গান গেয়ে নিই। আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন।


  


মিলন-গোধূলি রাঙা হয়ে এল এ


সোনার গগনময়।


দাও আশিস অভয়, হে দেব জ্যোতির্ময়॥


  মিলিল আবার দুইটি প্রাণ


  কত যুগ পরে, হে ভগবান,


সার্থক করো, হে মনোহর, এ মিলন অক্ষয়।


যেন চির-সুখী হয়, হে দেব জ্যোতির্ময়॥



মণি।

এই! বিয়ে যে হবে, তোমাদের ব্যান্ড কই, নহবত কই? শোন, আমি কেনেস্তার বাজাই, বুঝলি, আর, টুলি, তুই শিঙে ফোঁক। পঞ্চি, তুই ভেঁপু বাজা! বাজা, বাজা, বাজা!


  


(ক্যানেস্তারা ইত্যাদির বাদ্য)


  



কমলি।

দোহাই দাদা, থামো! তোমার রওশন-চৌকি মাথায় থাক। আমাদের রওশন-চৌকি আমাদের বাড়িতেই আছে। যা তো ভাই বেগম, তুই গ্রামোফোনে তালিম হোসেনের সেই সানাই-এর রেকর্ডখানা বাজা তো।



টুলি।

বা ভাই, বেশ মনে করিয়ে দিয়েছিস। (রেকর্ড বাজিয়ে উঠিল) । ওই যে রেকর্ডখানা বেজে উঠল। এতক্ষণে না বে-বাড়ি বলে মনে হচ্ছে!



পুরুত।

কই, বর কনেকে নিয়ে এসো। বরের হাতে কনের হাত দাও। আহা হাহা, অত জোরে না। বরের হাত যে দেহ ছেড়ে চলে এল। হাঁ হাঁ, এইবার ঠিক হয়েছে। এইবার বলো তো বাবা ডালিমকুমার—


যদিদং হৃদয়ং তব


তদিদং হৃদয়ং মম।



মণি।

অনুস্বারং আর বিসর্গ যদি সংস্কৃতং হয়তং তবে আমিং কেনং বসতং। এই! এইবার তোদের ফুচুং আর গেঁইসাকে নিয়ে আয়, আমি মন্তর পড়ি। হ্যাঁ বলো তো বাবা ফুচুং—


  


ওয়ানং মর্নিং আই মেটং এ লেমং ম্যানং


ক্লোজ টু মাই ফার্মং


  



পুরুত।

বাপরে বাপ, এ আবার কোন মন্তর রে বাবা! যেমন উনুনমুখো দেবতা, তেমনই ছাইপাঁশ নৈবিদ্যি।



কমলি।

দাদার মন্তর পড়া ঠিক হচ্ছে তো পুরুত মশাই?



পুরুত।

আরে, ওই হয়েছে! হোক না কাঠের বেড়াল, ইঁদুর ধরলেই হল। ওই কারুর বিয়েতে হয় না!



কমলি।

নে ভাই টুলি, নে ভাই বেগম, থুড়ি বেয়ান, এইবার তোদের জামাইকে আশীর্বাদ কর।



বেগম।

বাবা ফুচুং! উপরে আল্লা, নীচে তুমি। দেখো, আমার গেঁইসা যেন তোমার কাছে সুখে থাকে।


যেন গাই বাছুরে গোয়াল ভরে


ধনে জনে ঘর ভরে,


আদর আহ্লাদ উপচে পড়ে।


যেন অষ্ট সুখে খায়


সোনার পালঙ্কে নিদ্রা যায়।


ভিখ-ফকিরে আঁজলা আঁজলা ভিক্ষা পায়।


শ্বশুর শাশুড়ির চৌদোল এসে


পঞ্চ বাজন বাজিয়ে নিয়ে যায়।


  



টুলি।

বাবা! উপরের ভগবান, নীচে তুমি। তোমার হাতে মেয়েকে দিলুম। দেখো যেন কোনো কষ্ট দিয়ো না।


  


রাজরাজেশ্বর স্বামী হোক,


ভীমার্জুন ভাই হোক।


যেন উমার মতো আদর পাস,


নন্দী ভৃঙ্গী নফর পাস,


জয়া বিজয়া দাসী পাস,


কুবেরের ভাণ্ডার পাস।


ঘরে ঘটিবাটি ঝলমল করে,


আলনায় কাপড় দলমল করে।


বছর বছর পুত্র পাস।


হবে পুত্তুর মরবে না


চোখের জল পড়বে না।


  (উলু ও শঙ্খধ্বনি)


  



বেগম।

এই পঞ্চি, তুই সেই লাল টুকটুক গানখানা গা না ভাই।


  


(পঞ্চির গান)


লালা টুকটুক মুখে হাসি মুখখানি টুলটুল।


বিনি পানে রং দেখে যা লালা-ঝুঁটি বুলবুল॥


দেখতে আমার খুকুর বিয়ে


সূয্যি ওঠেন উদয় দিয়ে,


চাঁদ ওঠে ওই প্রদীপ নিয়ে


গায় নদী কুলকুল॥


  



খেঁদি।

আমি আর কী আশীর্বাদ করব খ, তুরাই যে সব বলে ফেললি!


  


জন্ম জন্ম এয়ো হবি,


জামায়ের সুয়োরানি হবি।


আকালের লক্ষ্মী হবি।


সময়ে পুত্রবতী হবি।


সোনার কলসি টলমল


ঘটে ঘটে গঙ্গা-জল।


এ কুল থেকে ও কুলে যাবি


দুই কুল শীতল করবি।


মায়ের কুলে ফুল বাপের কুলে ফল


শ্বশুর কুলে তারা,


তিন কুলে পড়বে জল গঙ্গা যমুনার ধারা।


মা গঙ্গা ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ বাসুকি


তিন কুল ভরে দাও ধনে জনে সুখী।



পঞ্চি।

আমি ভাই আর কী কইমু—


  


চুল মেলবা সোনার খাডে


নাইবা ধুইবা পদ্মার ঘাডে


ভাত খাইবা সোনার থালে


বেন্নন খাইবা রুপার বাডিতে।


আঁচাইবা ডাবর-ভরা


পান খাইবা বিরা বিরা।


সুপারি খাইবা ছরা ছরা


খয়ের খাইবা চাক্কা চাক্কা।


চুন খাইবা খুটরি-ভরা,


পেচকি ফেলাইবা লাদা লাদা।


(উলু ও শঙ্খধ্বনি)


  



কমলি।

নে ভাই, লগ্নের বেলা যে বয়ে গেল, এখন সকলে মিলে বর কনেকে বরণ করি। তার আগে ভাই, বেগম একটা ওদের বিয়ের গান গাক।


  


( বেগমের গান)


শাদি মোবারকবাদি শাদি মোবারক।


দেয় মোবারক-বাদ আলম রসুলে-পাক আল্লা হক॥


   আজ এ খুশির মহ‍্‍ফিলে


   দুলহা ও দুলহিনে মিলে


   মিলন হল প্রাণে প্রাণে


   মাশুক আর আশক॥


   আউলিয়া আম্বিয়া সবে


   এসো এ মিলন-উৎসবে,


   দোওয়া করো আজ এ খুশির


   গুলিস্তান গুলজার হোক॥



কমলি ঠাকুরমা।

ওরে ও-ও-ও-কমলি, ওলো ও টুলি, ওরে ভুলি রে, ও নবা—



টুলি।

ওরে কমলি, ওই শোন ঠাকুমা ডাকাডাকি করছে। এই বেলা আশীর্বাদের গানটা গেয়ে নে।


  


(গান)


  


  সাবিত্রী সমান হও, লহো লহো এই আশিস।


শ্বশুর শাশুড়ির মা বাপের কুলের তারা হয়ে হাসিস।


লহো লহো এই আশিস।


রামের মতো স্বামী পাস, সতী হোস সীতার সম,


দশরথ কৌশল্যার মতো শ্বশুর শাশুড়ি অনুপম।


লক্ষ্ণণ সম দেবর পেয়ে সুখের সায়বে ভাসিস।


লহো লহো এই আশিস।


গোয়ালে গোরু, মরায়ে ধান,


সিঁথেয় সিঁদুর, মুখে পান,


আলতা পায়ে চির-এয়োতি


যার সুখে দিন এক সমান।


অন্নপূর্ণা জগৎ-জীবের মা হয়ে ফিরে আসিস


লহো লহো এই আশিস।


  


সভা-উজ্জ্বল জামাই পাস,


ধরার মতো সহ্য পাস,


জন্মায়স্তে কাল কাটাস।


পাকা চুলে পরিস সিঁদুর হয়ে থাকিস স্বামীর সো।


বেঁচে থাকিস যতকাল অক্ষয় থাক তোর হাতের নো।


পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে গঙ্গাজলে দেহ রাখিস।


লহো লহো এই আশিস॥


(উলু ও শঙ্খধ্বনি)


  


সমাপ্ত

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !