দ্বিতীয় অঙ্ক
(ভোর হয়ে এল। পাখির কলরব ভেসে আসছে।)
বেণু :
কংকণদা, ওংকারদা! চোখ খোলো, আমরা সমুদ্দুর থেকে উঠে পৃথিবীতে এসে পড়েছি। ওই দেখো, সুয্যি উঠছে।
ওংকার :
বায়স্কোপের সুয্যি নয় তো! কল্পনাদির মায়ায় সব ভুল দেখছি মনে হচ্ছে।
কল্পনা :
খুকি, তুমি কোত্থেকে এলে? তোমার নাম কি?
বেণু :
আমার নাম বেণু। আমি কোথাও থেকে আসিনি, এইখানেই লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলুম। সব শুনেছি সব দেখেছি। ভয়ে কথাটি কইনি।
কল্পনা :
তা বেশ, আমরা এখন চাঁদের দেশে, মঙ্গল গ্রহে যাব। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে?
বেণু :
(ভয় পেয়ে) না! আমাকে ‘হেদো’-র কাছে নামিয়ে দাও, আমি এক ছুট্টে বাড়ি পালাব।
ওংকার :
তোর আঁচলে কী রে বেণু? অ! আমার হাফপ্যান্টের পকেট থেকে সব মুক্তো মানিক চুরি করেছিস বুঝি? দে, দে আমার মুক্তো দে।
বেণু :
বা রে, তোমার ছেঁড়া পকেট গলে ওগুলো আপনা থেকে আমার কাছে এসেছে। আমি চুরি করব কেন? আচ্ছা, ওংকারদা, তোমরা ব্যাটা ছেলে, তোমরা ও নিয়ে কী করবে? এখন ওগুলো আমার কাছে থাক, তোমার বউ এলে মালা গেঁথে উপহার দেব।
চাকাম-ফুসফুস :
(কল্পনাকে উদ্দেশ করে) কাল-ফণী দি! ওই শ্যামবাজারের দোতলা বাস যাচ্ছে– ওর ছাদে আমায় টুপ করে ফেলে দাও না। আমি সাঁ করে সোজা সরে পড়ি! কী সর্বনাশটাই হল আমার।
কল্পনা :
তোমার ভয় দূর না হওয়া পর্যন্ত এমনি ভয় দেখিয়ে নিয়ে বেড়াব তোমায়। ভয়ের মাঝে রেখেই তোমার ভয় দূর করব। আচ্ছা বেণু, তোমার কী ভালো লাগে? চাঁদের দেশ, না, মাটির পৃথিবী?
বেণু :
মাটির পৃথিবী। আমি এই পৃথিবীকে খুব ভালোবাসি। একে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। ও যেন আমার মা।
কল্পনা :
আচ্ছা, এই পৃথিবীতে তোমার কী হতে ইচ্ছা করে?
আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি।
সুয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’ মা বলবেন রেগে।
বলব আমি ‘আলসে মেয়ে, ঘুমিয়ে তুমি থাকো,
হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে নাকো?
আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?
তোমার মেয়ে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে।’
উষা দিদির ওঠার আগে উঠব পাহাড়-চূড়ে,
দেখব নীচে ঘুমায় শহর শীতের কাঁথা মুড়ে।
ঘুমায় সাগর বালুচরে নদীর মোহনায়,
বলব আমি, ‘ভোর হল যে, সাগর ছুটে আয়’।
ঝরনা-মাসি বলবে হাসি, ‘খুকি এলি না কি?’
বলব আমি, ‘নইকো খুকি, ঘুম-জাগানো পাখি। ’
ওংকার :
কল্পনাদি! মঙ্গল গ্রহ না চাঁদের দেশে যাবে বলছিলে না? সমুদ্রের জলে ভিজে আমার ভীষণ সর্দি ধরেছে – তাই বলছিলুম যা যুদ্ধ লেগেছে কল্পনাদি, তাতে বুঝে দেখলুম, আমার রাজা টাজা হওয়া পোষাবে না। ও ঝক্কির চেয়ে অনেক ভালো –
আমি হব গাঁয়ের রাখাল ছেলে!
বলব, ‘দাদা, প্রণাম তোমায়, ঘুম ভাঙিয়ে গেলে।’
আঁচল ভরে মুড়ি নেব, হাতে নেব বেণু,
নদীর পারে মাঠের ধারে নিয়ে যাব ধেনু।
বাছুরটিরে কোলে করে পার হব বিল খাল,
বটের ছায়ায় জুটবে এসে রাখাল ছেলের পাল।
আমি হব রাখাল-রাজা মাঠের তেপান্তরে,
ছাতিম তরু ধরবে ছাতা আমার মাথার পরে।
শালের পাতায় মুকুট গড়ে পরিয়ে দেবে তারা,
সিংহাসনে পাতবে এনে নবীন ধানের চারা।
সন্ধ্যা হলে বাজিয়ে বেণু গোঠের ধেনু লয়ে
ফিরব ঘরে মাঠের রাখাল মায়ের দুলাল হয়ে!
কঙ্কণ :
কল্পনাদি, তোমার রথ থামিয়ো না। চলো হিমালয়ের গৌরীশংকরের চূড়ায়, উত্তরমেরু, বরফ পেরিয়ে নাম না জানা দেশে। চলো চাঁদের বুকে, মঙ্গল গ্রহে।
কল্পনা :
তোমায় নিয়ে যাব কঙ্কণ, অসীমের সীমা খুঁজতে – অকূলের কূল দেখাতে। তার আগে তোমার পৃথিবীর কাজ সেরে নিতে হবে । ধরো, পৃথিবীতে যদি তোমায় কাজ করতে হয় – তুমি কী করবে?
কঙ্কণ :
আমি গাইব গান – আর সারা পৃথিবীর মানুষ ধরবে তার ধুয়া।
(গান)
চল্ চল্ চল্
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে বাদল....
কল্পনা :
শুধু গান গাইবে? কর্ম করবে না?
কঙ্কণ :
কর্মই তো আমার প্রাণ। কাজ করি বলেই তো রাত পোহায়।
আমি হব দিনের সহচর –
বলব, ‘ওরে, রোদ উঠেছে, লাঙল কাঁধে কর!
তোদের ছেলে উঠল জেগে, ওই বাজে তার বাঁশি,
জাগল দুলাল বনের রাখাল, ওঠ রে মাঠের চাষি।’
‘শ্যাওলা’ ‘হাঁসা’ দুই না বলদ দুই ধারেতে জুড়ে
লাঙলের ওই কলম দিয়ে মাটির কাগজ খুঁড়ে
লিখব সবুজ-কাব্য আমি, আমি মাঠের কবি –
ওপর হতে করবে আশিস দীপ্ত রাঙা রবি।
ধরায় ডেকে বলব, ‘ওগো শ্যামল বসুন্ধরা
শস্য দিয়ো আমাদের এবার আঁচল-ভরা।
জংলি মেয়ে ছিলে তুমি, ছিল নাকো ছিরি,
মরুর বুকে থাকতে শুয়ে ফিরতে দরি গিরি।
আমরা তোমায় পোষ মানিয়ে দিয়েছি ঘর বাড়ি
গা-ভরা তোর গয়না মা গো, ময়নামতীর শাড়ি!
জংলা কেটে খেত করেছি, ফসল সেথা ফলে,
পাহাড়ে তোর বাংলো তুলে দ্বীপ রচেছি জলে।
বন্য-মেয়ে! আমরা তোরে করেছি রাজরানি,
ধুলাতে তোর পেতেছি মা সোনার আসনখানি।
খামার ভরে রাখব ফসল, গোলায় ভরে ধান,
ক্ষুধায় কাতর ভাইগুলিকে আমি দেব প্রাণ।
এই পুরাতন পৃথিবীকে রাখব চিরতাজা,
আমি হব ক্ষুধার মালিক, আমি মাটির রাজা॥
(হঠাৎ সকলে ‘ধর ধর গেল’ বলে চিৎকার করে উঠল। চাকাম-ফুসফুসের ‘কী সর্বনাশটাই হল রে বাবা’ বলে চিৎকার শোনা গেল)
ওংকার :
কল্পনাদি, কল্পনাদি, ধরো ধরো, চাকাম-ফুসফুস হেদোর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
কল্পনাদি :
(হেসে) ভয় নেই, ও জল থেকে সাঁতরে ডাঙায় উঠে বাড়ির দিকে দৌড় দেবে! তবে দৌড়ে পালাবে কোথায়? আবার আমার কাছে ধরা দিতেই হবে! – ও কি, বেণু কাঁদছ? ওগুলো মুক্তো মানিক নয়। তোমরা শুধু ঝিনুক কুড়িয়ে এনেছ। যেদিন তোমার দাদারা সত্যিকার সাগর জয় করে আসবে আর তোমরা মেয়েরা তাদের সাহায্য করবে ওই সাগর অভিযানে – সেইদিন সত্যিকারের মুক্তো মানিক পাবে। – তার আগে নয়।
কঙ্কণ :
ওদের নামিয়ে দিয়ে আমায় নিয়ে চলো না কল্পনাদি চাঁদের দেশে। সেখান থেকে আনব–অমৃত পৃথিবীতে, জরা মৃত্যু থাকবে না – থাকবে শুধু সুন্দর চির-কিশোর।
[রথের দূরে যাওয়ার শব্দ]
* * *
( উড়ে চাকরের প্রবেশ)
হেই খোকাবাবু সব উঠো উঠো। সারা রাত্তির কি ছাদে শুয়ে থাকবে? ঠান্ডা লাগিব যে! উঠো! উঠো!
ওংকার :
কঙ্কণদাকে উঠিয়ো না – ও এখন ‘রকেট’ করে চাঁদের দেশে গিয়ে জ্যোৎস্নার আরক খাচ্ছে। আমি ততক্ষণ ওর পকেটের কমলালেবুটা খেয়ে ফেলি!
–যবনিকা–
No comments:
Write comments