জাগো সুন্দর চিরকিশোর
প্রথম অঙ্ক
(কোরাস গান)
জাগো সুন্দর চিরকিশোর
জাগো চির-অমলিন দুর্জয় ভয়-হীন
আসুক শুভদিন, হোক নিশি-ভোর॥
অগ্নি-শিখার সম সূর্যের প্রায়
জ্বলে ওঠো দিব্যজ্যোতির মহিমায়,
দূর হোক সংশয়, ভীতি, নিরাশা,
জড়-প্রাণ পাষাণের ভাঙো ঘুমঘোর॥
কঙ্কণ :
ওংকার! ওংকার! খেলতে খেলতে আমরা এ কোথায় এসে পড়েছি? কে আমাদের এখানে আনলে?
কল্পনা :
আমি – তোমাদের দিদি কল্পনা। কঙ্কণ! ভালো করে চেয়ে দেখো দেখি আমাকে চিনতে পার কি না।
কঙ্কণ :
না – হ্যাঁ – তোমায় যেন কোথায় দেখেছি, অথচ ঠিক মনে করতে পারছিনে।
কল্পনা :
আচ্ছা, আমি মনে করিয়ে দিই। কাল রাত্রে ছাদে বসে চাঁদের দিকে চেয়ে চুপ করে কী ভাবছিলে, মনে পড়ে?
কঙ্কণ :
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ভাবছিলাম আমি যদি ওই চাঁদের দেশে এক নিমিষে উড়ে যেতে পারতুম, তা হলে কী মজাই না হত। তারপর মনে হল আমার মনের ভিতর কে যেন এক ডানাওয়ালা সুন্দরী পরি আছে, সে যেন জাদু জানে, সে যেন এক নিমিষে আমায় যেখানে ইচ্ছা সেইখানে নিয়ে যেতে পারে!
কল্পনা :
ঠিক ধরেছ! এখন চেয়ে দেখো দেখি, আমি সেই পরির মতো কিনা!
কঙ্কণ :
আরে, ঠিক সেই তো! এক্কেবারে হুবহু মিল! আমার মনের সেই পরি তুমি। তোমার নাম কি বললে?
কল্পনা :
আমার নাম কল্পনা। আমায় কল্পনাদি বলে ডেকো!
কঙ্কণ :
ধ্যাৎ, তুমি যে মাথায় আমারই মতো বড়ো। তোমাকে – আচ্ছা দিদি বললে যদি সুখী হও, তাই বলব। কিন্তু –
কল্পনা :
বুঝেছি – আর বলতে হবে না। তুমি যেখানে যেতে চাইবে, আমি সেইখানেই নিয়ে যাব। এখন চলো সাগর-জলের তলে। (সাগরের শব্দ ভেসে এল)...
কামাল :
এই কঙ্কণ ! পালিয়ে আয়! ও জাদু জানে, পরির বাচ্চা, উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এই যাঃ! তোর মাদুলিটা ফেলে এসেছিস বুঝি? –দেখি আমার তাবিজটা আছে কি না! অ্যাঁ, আমার তাবিজটা – কে নিলে?
কল্পনা :
এখন আর কোনো বীজেই কিন্তু ফল হবে না কামাল! আমি তোমাদের ফুলের রথে করে সমুদ্র-জলে নামতে শুধু করেছি ! ওকী ওংকার, অমন চোখ বুঁজে আছ কেন?
ওংকার :
ভয় পেলে আমি চোখ বুঁজে বসে থাকি। কিংবা প্রাণপণে চেঁচিয়ে গান করি।
কল্পনা :
এই চোখ বোঁজা কার কাছে শিখলে?
ওংকার :
হ্যাঁ,আমাদের গায়ে দেখেছিলুম, একপাল ভেড়ার মাঝে একটা নেকড়ে বাঘ এসে পড়ল। যাঁহা নেকড়ে বাঘ দেখা, আর অমনি পালের সব ভেড়া গোল হয়ে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইল।
কল্পনা :
আর, তাই দেখে বুঝি নেকড়ে বাঘ পালিয়ে গেল!
ওংকার :
দূর! তা হবে কেন? নেকড়ে বাঘ ভেড়াদের এক একটার কান ধরে ঘাড় মটকে রেখে আসে, এসে আবার একটার কান ধরে নিয়ে যায়!
চাকাম ফুসফুস :
ওরে ব্বাবারে। গেছি রে গেছি রে, একেবারে মরে গেছি রে মা!(সমস্ত ‘স’ এর উচ্চারণ দন্ত্য ‘স’ দিয়ে) আজ সকালে সালকের শ্মশান ঘাটে সিনান করতে গিয়ে এই সর্বনাশটা হল। শ্মশানের শ্যাওড়া গাছের শাঁখচুন্নিতে ধরেছে রে বাবা!
কল্পলা :
ও কে চিৎকার করে অমন করে? কে ওই ভীরু?
কঙ্কণ :
ওর নাম ন্যাড়া, আমরা ওর নাম রেখেছি চাকাম-ফুসফুস! ও বড়ো ভীতু কিনা! একটু ভয়ের কথা শুনলেই ওর ফুসফুস চুপসে গিয়ে বুকে গর্ত হয়ে যায়।
কামাল :
আর মুখ শুকিয়ে গিয়ে চাকাম চুকুম শব্দ করতে থাকে–তাই ওংকার ওর নাম রেখেছে চাকাম ফুসফুস! – (সমুদ্রের শব্দ)
কামাল :
কী ঠান্ডা হিমেল বাতাস! আমার গা শিরশির করছে!
চাকাম ফুসফুস :
আমার দাঁতে দাঁত লাগছে। শ্মশান দেখে কী সর্বনাশটাই হল! হি হি হি হি! (দাঁতে দাঁত লাগার শব্দ।)
কঙ্কণ :
আমার কিন্তু চমৎকার লাগছে কল্পনাদি, কিন্তু অত অন্ধকার কেন? সমুদ্রে কি আলো নেই?
কল্পনা :
সাগর-জলের নীচে মণিমুক্তার আলো। আর দেরি নেই, ওই আমরা এসে পড়েছি – সাগরজলের পাতালতলে! খোলো দুয়ার ।
(হঠাৎ যন্ত্রসংগীত ও সাগর-গর্জন বন্ধ হয়ে গেল।)
কঙ্কণ :
(হাত তালি দিয়ে) কল্পনাদি, দেখো দেখো কী সুন্দর আলো। কত হিরা মানিক মুক্তো! কামাল! ওংকার!
কামাল :
এই কঙ্কণ, খবরদার, ও-সব হিরা মানিক ছুঁসনে! আমাদের গাঁয়ে একজন পুথি পড়ছিল, তাতে লেখা আছে – ওসব পরিদের হিকমত। ছুঁলেই পাথর হয়ে যাবি!
ওংকার :
হাফপ্যান্টের পকেট তো ভরতি হয়ে গেল হিরা মানিকে। আর নিই কোথায়? বাবাকে কতবার বললাম যে, হাফপ্যান্টের দুটো বুকপকেট করে দাও, তা বাবা শুনলেন না। গায়ের জামাটাও ভুলে এলুম!
চাকাম ফুসফুস :
ওরে বাপ রে! কী সর্বনাশটাই হল। এ যে খই মুড়ির মতো হিরা ছড়ানো রয়েছে! নিলে শ্যাওড়া গাছের ওই শাঁকচুন্নিটা ধরবে না তো?
কল্পনা :
শোনো কঙ্কণ, ওংকার, কামাল! তোমরা বড়ো হয়ে আসবে এই সাগর-জয়ে। এই সাগরকে যে-বীর জয় করবে – সেই পাবে এই সাগরতলের হিরা মানিক মুক্তা। এই পাঞ্চজন্য শঙ্খে বেজে উঠবে তারই শুভ আগমনি বার্তা! কামাল তুমি কী হবে?
কামাল :
আমি সাগর পাড়ি দেব, হব সওদাগর।
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর।
আমার ঘাটের সওদা নিয়ে যাব সবার ঘাটে,
চলবে আমার বেচাকেনা বিশ্বজোড়া হাটে!
ময়ূরপঙ্খি বজরা আমার লাল রঙা পাল তুলে
ঢেউ-এর দোলায় হাঁসের মতন চলবে হেলে দুলে।
চারপাশে মোর গাংচিলেরা করবে এসে ভিড়,
হাতছানিতে ডাকবে আমায় নতুন দেশের তীর।
কঙ্কণ :
সপ্ত সাগর রাজ্য আমার, হব সিন্ধুপতি;
আমার রাজ্যে কর জোগাবে রেবা ইরাবতী।
কত সিন্ধু ভাগীরথী॥
রক্তরাঙা পলার দ্বীপে রাজধানী মোর হবে,
জয়গান মোর উঠবে নিতুই সাগর-রোলের স্তবে।
সপ্তদ্বীপা পৃথিবীরে রইবে সদা ঘিরে
যেন কোলের খোকার মতো আমার সাগর-নীরে!
সাগরতলের সপ্ত পাতাল নাই সন্ধান যার
জয় করব, আমি তারে করব আবিষ্কার॥
(সাগর-জলের শব্দ! পুষ্পরথ যেন সাগর হতে উঠে অন্যত্র চলে গেল।)
No comments:
Write comments