Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Wednesday, December 14, 2016

তৃতীয় অঙ্ক

তৃতীয় অঙ্ক


[গান্ধার রাজ্যের প্রমোদ-প্রাসাদ। মধুশ্রবা, তরুণী কিশোরীর দল, রঙ্গনাথ, কাকলি প্রভৃতি আসীন। মীনকেতু তখনও আসেনি ; বৈতালিক গান।]


[গান]


  



বৈতালিক :

আসিলে কে অতিথি সাঁঝে।



  

পূজার ফুল ঝরে বন-মাঝে।।



  

দেউল মুখরিত বন্দনা-গানে



  

আকাশ-আঁখি চাহে মুখপানে,



  

দোলে ধরাতল দীপ-ঝলমল



  

নৌবতে ভূপালি বাজে।।


  


[হাসিতে হাসিতে মীনকেতুর প্রবেশ। তরুণী ও কিশোরীদলের নৃত্য ও গান]


  


[গান]


  



তরুণী ও কিশোরীরা :

মাধবী-তলে চলো মাধবিকা দল



  

         আইল সুখ-মধুমাস



  

পিককুল কলকল অবিরল ভাষে,



  

         মধুপ মদালস পুষ্প-বিলাসে,



  

           বেণু-বনে ব্যাকুল উছাস।।



  

তরুণ নয়ন-সম আকাশ আ-নীল



  

তট-তরু-ছায়া ধরে নীর নিরাবিল,



  

         বুকে বুকে দীরঘ নিশাস।।


  


[গীত-শেষে কাকলি পরিপূর্ণ সুরার পাত্র আগাইয়া দিল]


  



মীনকেতু :

(সুরার পাত্র নিঃশেষ করিয়া ফিরাইয়া দিয়া) শুধু সুরা নয় কাকলি, সুরার সঙ্গে সুর চাই। তোমার বীণা বিনিন্দিত কণ্ঠের সুর। আজ যে আমার তাকেই দেখার দিন, যাকে কখনও দেখিনি।


  


[গান]


  



কাকলি :

গহিন রাতে –



  

         ঘুম কে এলে ভাঙাতে



  

ফুলহার পরায়ে গলে,



  

         দিলে জল নয়ন-পাতে।।



  

যে জ্বালা পেনু জীবনে



  

ভুলেছি রাতে স্বপনে,



  

কে তুমি এসে গোপনে



  

         ছুঁইলে সে বেদনাতে।।



  

যবে কেঁদেছি একাকী



  

কেন মুছালে আঁখি



  

নিশি আর নাহি বাকি



  

         বাসি ফুল ঝরিবে প্রাতে।।


[সাধারণ নাগরিকের শ্বেত বস্ত্রে সজ্জিত হইয়া তরবারিশূন্য খাপ হস্তে সেনাপতি চন্দ্রকেতুর প্রবেশ]


  



মীনকেতু :

(উঠিয়া পড়িয়া) একী! সেনাপতি? শ্বেত পতাকা জড়িয়ে এসেছ বন্ধু!



চন্দ্রকেতু :

(মীনকেতুর পদতলে তরবারি খাপ রাখিয়া) সম্রাট! আমি আর সেনাপতি নই। আজ হতে আমার নাম শুধু চন্দ্রকেতু। আমার আর সেনাপতিত্ব করবার অধিকার নেই। আমি পরাজিত হয়েছি। পরাজিতের গ্লানি ভুলবার একমাত্র উপায় যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি তাই স্বেচ্ছায় আমি নিজেকে চির-নির্বাসন দণ্ড দিয়েছি। আজ আর আমার মনে কোনো গ্লানি নাই, মৃত্যু-লোকের পথ রুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু আমি অমৃতলোকের পথের দিশা পেয়েছি।



মীনকেতু :

জিজ্ঞাসা করতে পারি কি বন্ধু, তোমার এই অমৃতলোকের পথের দিশারিটি কে?



চন্দ্রকেতু :

আমার, না – একা আমার কেন – সর্বলোকের বিজয়িনী এক নারী। তার নাম আমি করব না। আজ আমি সত্যই বুঝতে পেরেছি সম্রাট, হৃদয়ের রণভূমিতে যে জয়ী হয়, শত যুদ্ধজয়ের সেনাপতির চেয়েও সে বড়ো। হৃদয় জয় করতে না পারার বেদনা আমার বাহুকে যে এমন শক্তিহীন করে তুলবে, এ আমার কল্পনার অতীত ছিল।


  



মীনকেতু :

(চন্দ্রকেতুর পিঠ চাপড়াইয়া) দুঃখ কোরো না বন্ধু, ও পরাজয়ের মধুর আস্বাদ একদিন তোমাদের মীনকেতুকে – এই যৌবনের সম্রাটকেও পেতে হবে! সুন্দর হাতের পরাজয় কি পরাজয়? কিন্তু সেই বিজয়িনীর কাছে তুমি পরাজিত হলে অস্ত্রের যুদ্ধে, না বিনাঅস্ত্রের যুদ্ধে?



চন্দ্রকেতু :

(ম্লান হাসি হাসিয়া) দুই যুদ্ধেই সম্রাট, যদিও ওখানে বিনাঅস্ত্রের যুদ্ধ করতে যাইনি। আমার সৈন্য নিয়ে গৈরিকস্রাবের মতো যশলমিরসৈন্যর উপর গিয়ে পড়লুম। প্রায় পরাজিতও করে এনেছিলুম, এমন সময় আষাঢ়ের মধ্যাহ্ন-সূর্যের মতো দীপ্তি নিয়ে এল জয়ন্তী – যশলমিরের অধীশ্বরী। এতরূপ আমি আর দেখিনি। এইটুকু দেহের আধারে এত রূপ কী করে ধরল, সকল রূপের স্রষ্টাই বলতে পারেন। ও যেন বিশ্বের বিস্ময়। কিন্তু রূপের চেয়েও সুন্দর তার চোখ। ও চোখে যেন সূর্য-চন্দ্র লুকোচুরি খেলছে।



মীনকেতু :

বড়ো বাড়িয়ে বলছ চন্দ্রকেতু। তারপর কি হল বল।



চন্দ্রকেতু :

আমি তখনও সেনাপতি উগ্রাদিত্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে ব্যাপৃত। জয়ন্তী যেমন অপরূপ সুন্দর, উগ্রাদিত্য তেমনই ভীষণ কুৎসিত। ওর শরীরে যেন সকল পশুর সকল দানবের শক্তি। ও যেন নিখিল অসুরের প্রতীক। বুঝলাম, দেবী-শক্তির সঙ্গে দানব-শক্তি মিশেছে এসে। এ শক্তি অপরাজেয়।



মীনকেতু :

(অস্থিরভাবে পায়চারি করিতে করিতে) হাঁ, এখন বুঝতে পেরেছি ও শক্তির উৎস কোথায়?



চন্দ্রকেতু :

হয়তো-বা উগ্রাদিত্যের হাতেই পরাজিত হতুম, কিন্তু সে লজ্জা থেকে বাঁচালে এসে জয়ন্তী। সে উগ্রাদিত্যকে সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে, “তুমি তো এ যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না সেনাপতি ; তুমি ফিরে যাও।” আমি বললুম, “আমি যুদ্ধস্থল থেকে কখনও পরাজয় নিয়ে ফিরিনি।” সে হেসে বললে, “তুমি হৃদয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্ষত-বিক্ষত। আহত সেনানীকে আমার সেনানীর আঘাত করতে বাধে না, কিন্তু আমার বাধে। তোমার চোখ তো সৈনিকের চোখ নয়, ও চোখে মৃত্যু-ক্ষুধা কই, ও যে প্রেমিকের চোখ, হতাশার বেদনায় ম্লান!” আমি যেন এক মুহূর্তে ওই নারীর মনের আরশিতে আমার সত্যকার আহত মূর্তি দেখতে পেলাম। আমার হাত হতে তরবারি পড়ে গেল।



মীনকেতু :

(অভিভূতের মতো) হাঁ, এই সেই! এই সেই বিজয়িনী। আমার যেন মনে পড়ছে স্বর্গে আমি ছিলুম পঞ্চশর, শিবের অভিশাপে এসেছি মর্ত্যলোকে। ওই বিজয়িনী ও জয়ন্তী নয়, ও রতি! (হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া) তা নয়, তা নয়। হাঁ, তারপর চন্দ্রকেতু, তুমি ফিরে এলে? ভ্রষ্ট তরবারি আবার কুড়িয়ে নিলে না?



চন্দ্রকেতু :

ভ্রষ্টা শক্তিকে আর গ্রহণ করিনি। ওকে চিরকালের জন্য ওই রণক্ষেত্রে বিসর্জন দিয়ে এসেছি।



মীনকেতু :

(হাসিয়া উঠিয়া) ভুল করেছ বন্ধু! রামের মতোই রামভুল করে বসেছ! ও শক্তি ভ্রষ্টা নয়, ও সীতার মতোই সতী।




চন্দ্রকেতু :

এইবার তারই অগ্নি-পরীক্ষা হবে! কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও লোকলজ্জায় ওকে গ্রহণ করতে পারব না। আমাদের মাঝে চিরনির্বাসনের যবনিকা পড়ে গেছে।


  



  

[সহসা দশদিক আলোময় হইয়া উঠিল। যশলমির-রাজ্যেশ্বরী জয়ন্তী ও সেনাপতি উগ্রাদিত্যের প্রবেশ ও শঙ্খ তূর্যধ্বনি]


  



জয়ন্তী :

(চন্দ্রকেতুর পানে তরবারি আগাইয়া দিয়ে) না সেনাপতি! ওকে নির্বাসন দিলে রামের মতো তোমারও চরম দুর্গতি হবে। এই ধরো তোমার পরিত্যক্তা শক্তি। আমি অগ্নিশিখা। ওর অগ্নি-শুদ্ধি হয়ে গেছে।



চন্দ্রকেতু :

(বিস্ময়-অভিভূত কণ্ঠে চমকিত হইয়া) সম্রাট! সম্রাট! এই – এই সেই মহীয়সী নারী। এই জয়ন্তী!


  



  

[মীনকেতু তরবারি মোচন করিয়া জয়ন্তীর দিকে এবং জয়ন্তীও মীনকেতুর দিকে অভিভূতের মতো বুভুক্ষু দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিল। দূরে মধুর সুরে বংশী বাজিয়া উঠিল। সহসা মীনকেতুর হাত হইতে তরবারি পড়িয়া গেল। উগ্রাদিত্যের চক্ষু ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতো জ্বলিতে লাগিল।]


  



উগ্রাদিত্য :

রানি, আমি কি এদের বন্দি করতে পারি?



জয়ন্তী :

উগ্রাদিত্য, পরাজিত হলেও ইনি সম্রাট। ওঁর সম্মান রেখে কথা বলো।



উগ্রাদিত্য :

মার্জনা করো রানি, যে পরাজিত হয় তার বন্দি ছাড়া আর কোনো সংজ্ঞা নেই। সম্রাট হলেও সে বন্দি।



জয়ন্তী :

বন্দি করতে হয়, আমি নিজ হাতে বন্দি করব।



মীনকেতু :

তুমি কোন্ পথ দিয়ে এলে রানি?



জয়ন্তী :

তোমার পরাজয়ের পথ দিয়ে সম্রাট! এখন তুমি কি স্বেচ্ছায় বন্দি হবে, না যুদ্ধ করবে?



মীনকেতু :

যুদ্ধ? কার সাথে যুদ্ধ রানি! যেদিন তুমি আমার রাজ্যের সীমান্ত অতিক্রম করেছ, সেদিনই তো আমার পরাজয় হয়ে গেছে।



জয়ন্তী :

শুধু ওইটুকুতেই শেষ হবে না সম্রাট। তোমাকে চরম পরাজয়ের লজ্জা স্বীকার করতে হবে আমার কাছে – নারীর শক্তির কাছে। তোমাকে শিকল পরতে হবে এবং সে শিকল সোনার নয়!



মীনকেতু :

সুন্দর হাতের সোনার ছোঁয়ায় লোহার শিকলই সোনা হয়ে উঠবে। (হাত আগাইয়া) বন্দি করো, রানি!



জয়ন্তী :

কিন্তু বিনা যুদ্ধে তুমি হার মানবে? আমার কাছে না-হয় হার মানলে কিন্তু ওই উগ্রাদিত্য, আমার সেনাপতি – ওর কাছেও কি পরাজয় স্বীকার করবে?



মীনকেতু :

(উগ্রদিত্যকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়া) ও কে? ওকে তো দেখিনি! ও তো এ পৃথিবীর মানুষ নয়।




উগ্রাদিত্য :

(হিংস্র হাসি হাসিয়া) আমি পাতাল-তলের দৈত্য, সম্রাট! আজ তোমাকে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতেই হবে। আজ আমাদের শক্তি পরীক্ষার দিন।



মীনকেতু :

(জ্বলন্ত চোখে উগ্রাদিত্যের দিকে চাহিয়া) হাঁ। ওর সাথে যুদ্ধ করা যায়। ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত অপরাজেয় পৌরুষের পাষাণে মোড়া! হাঁ, সত্যকার পুরুষ দেখলুম! আমার সমস্ত মাংসপেশি ওকে দেখে লোহার মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। শিরায় শিরায় চঞ্চল রক্তের উন্মাদনা জেগে উঠছে। নিশ্চয়ই! তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব সেনাপতি! কিন্তু কী পণ রেখে যুদ্ধ করবে তুমি?



উগ্রাদিত্য :

(হিংস্র আনন্দে উন্মত্ত হইয়া উঠিল। জয়ন্তীকে দেখাইয়া) আমার পণ এই অমৃত-লক্ষ্মী সম্রাট। যার লোভে আমি পাতাল ফুঁড়ে ওই অমৃতলোকে উঠে গেছি শক্তির ছদ্মবেশে। তাকে যদি আজ জয় করতে না পারি তাহলে আমার তোমার হাতে মৃত্যুই তার উপযুক্ত শাস্তি!



জয়ন্তী :

(দৃপ্তকণ্ঠে) উগ্রাদিত্য! তুমি তাহলে ছদ্মবেশী লোভী, শক্তিধর নও।



উগ্রাদিত্য :

আজ আমি সত্য বলব রানি। আমি অসুর-শক্তি নই, আমি লোভ-দানব। আমার বাহুতে যে অমিত শক্তি, তা আমার ওই অপরিমাণ ক্ষুধারই কল্যাণে। আজ আমার সত্য প্রকাশের চরম মুহূর্ত উপস্থিত।



জয়ন্তী :

মিথ্যাচারী! (মীনকেতুর পতিত তরবারি তুলিয়া মীনকেতুর হাতে দিয়া) আর আমার ভয় নেই সম্রাট, তুমি জয়ী হবে। ও শক্তির প্রতীক নয়, ও লোভীর ক্ষুধাজীর্ণ মূর্তি, তোমার এক আঘাতেই ও চূর্ণীকৃত হয়ে যাবে।



উগ্রাদিত্য :

কী সম্রাট, তুমি কি ওই বিক্ষিপ্ত অস্ত্রই গ্রহণ করবে, না রিক্তহস্তে আত্মরক্ষা করবে?



মীনকেতু :

(হাসিয়া) আমি চন্দ্রকেতু নই, উগ্রাদিত্য। আমারই শিথিল মুষ্টির জন্য যে শক্তি পতিত হয়, তাকে আবার হাতে তুলে নিতে আমার লজ্জা নেই। তুমি লোভ-দানব, তোমার উদরে দশ মুখের ক্ষুধা, হস্তে বিশ হস্তের লুণ্ঠন আর প্রহরণশক্তি। তোমার সঙ্গে অহিংসযুদ্ধ করা চলে না। আমি অস্ত্র গ্রহণ করলুম।



উগ্রাদিত্য :

তোমার পণ?



মীনকেতু :

আমারও পণ ওই অমৃত-লক্ষ্মী (মীনকেতু চতুর্থ বার তরবারি আঘাত করিতেই উগ্রাদিত্য পড়িয়া গেল)



জয়ন্তী :

(সহসা কাঁপিয়া উঠিয়া) সম্রাট! মীনকেতু! ও কী করলে তুমি, তোমায় দিয়ে একী করালুম আমি? ও যে আমার শক্তি, লোভ, ক্ষুধা, সব – ওই লোভ, ওই ক্ষুধার শক্তি নিয়েই যে তোমায় জয় করতে বেরিয়েছিলুম। উঃ! মীনকেতু! আজ আমার প্রথম মনে হচ্ছে, আমি রাজ্য শাসনের রানি নই, অশ্রুজলের নারী।


[চন্দ্রিকার প্রবেশ]



চন্দ্রিকা :

একী এ কোথায় এলুম! এই কী অন্ধপতির প্রেমে-অন্ধ গান্ধারীর দেশ। এই কী হৃদয়ের সেই চিররহস্যময় পুরী? ওরা কারা দাঁড়িয়ে? মূক, মৌন, ম্লান। ওই ঙ্গক আলেয়ার পিছনে ঘুরে-মরা চির-পথিকের দল? ওরা সব যেন চেনা! ওদের কোথায় কোন্ লোকে যেন দেখেছি। (পতিত উগ্রাদিত্যকে দেখিযা) ও কে? – দিদি? আর এ কে? অ্যা! উগ্রাদিত্য? এখানে এত রক্ত কেন? (আর্তনাদ করিয়া উঠিয়া) উগ্রাদিত্য! এ কী, কে তোমায় হত্যা করলে? দিদি! দিদি!



মীনকেতু :

(শান্ত স্বরে) দেবী! উগ্রাদিত্যকে আমিই হত্যা করেছি! ও দৈত্য, অমৃত পান করতে এসেছিল! ওই ওর নিয়তি!



জয়ন্তী :

চন্দ্রিকা! উগ্রাদিত্য চলে গেছে আমার সকল শক্তি অপহরণ করে। তুই পারবি চন্দ্রিকা ওকে বাঁচাতে তোর তপস্যা দিয়ে? নইলে আমি বাঁচব না। ওকে বাঁচাতেই হবে।



চন্দ্রিকা :

দিদি! ওকে নিয়ে তোমার চেয়ে আমার প্রয়োজনই যে বেশি। ওকে না বাঁচালে আমাদের পৃথিবী যে চির-সন্ন্যাসিনী হয়ে উঠবে। এর জন্য যদি মৃত্যু-রাজার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে হয়, তাও দাঁড়াব গিয়ে! সাবিত্রীর মতো আমার এই শবের মধ্যে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করার তপস্যা আজ হতে শুরু, আজ হতে আমার নাম হবে কল্যাণী!



জয়ন্তী :

(দাঁড়াইয়া উঠিয়া) আশীর্বাদ করি, তুই রক্ষকুলবধূ প্রমীলার মতো স্বামীসোহাগিনি হয়ে সহমরণ নয়, সহজীবন লাভ কর! (মীনকেতুকে নমস্কার করিয়া) বন্ধু! নমস্কার! আমি তোমায় বন্দী করতে এসেছিলুম হয়তো-বা বন্ধন নিতেও এসেছিলুম। কিন্তু সে বন্ধন আজ ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ছিন্ন হয়ে গেল! উগ্রাদিত্যের মৃত্যুর সাথে সাথে আমার হৃদয়ের সকল ক্ষুধা সকল লোভের অবসান হয়ে গেল। আমি আজ রিক্তা সন্ন্যাসিনী! (একটু থামিয়া) আমি এই সুদূর পৃথিবীতে সন্ন্যাসিনী হতে আসিনি। বধূ হওয়ার, জননি হওয়ার তীব্র ক্ষুধার আগুন জ্বেলে তোমাকে জয় করতে এসেছিলুম। তোমাকেও পেলুম কিন্তু বুকের সে আগুন আমার নিভিয়ে দিয়ে গেল উগ্রাদিত্য!



মীনকেতু :

জয়ন্তী! তুমিও কি তবে ওকে ভালোবাসতে? তাহলে জয় করেও কি আমার পরাজয় হল? উগ্রাদিত্য মরে হল জয়ী! যাকে পণ রেখে জয় করলুম – সে কি আপন হল না?



জয়ন্তী :

কায়াহীন ভালোবাসা নিয়ে যারা তৃপ্ত হয়, তুমি তো তাদের দলের নও মীনকেতু। তুমি চাও জয়ন্তীকে, এই মুহূর্তের রিক্তাকে নিয়ে তুমি সুখী হতে পারবে না। যে তেজ যে দীপ্তির জোরে তোমায় জয় করলুম – সেই তো ছিল উগ্রাদিত্য। তোমার হাতে তার পতন হয়ে গেছে! বন্ধু! বিদায়!



মীনকেতু :

(আর্তকণ্ঠে) জয়ন্তী! আর কী তবে আমাদের দেখা হবে না?



জয়ন্তী :

হয়তো হবে, হয়তো-বা হবে না! যদি আমার মনে আবার সেই ক্ষুধা জাগে, যদি ওই উগ্রাদিত্য প্রাণ পায়, কল্যাণীর সিঁথিতে সিঁদুর ওঠে, আমি আবার আসব। সেনাপতি নমস্কার!


[প্রস্থান]



মীনকেতু :

(উন্মাদের মতো চিৎকার করিয়া উঠিল) জয়ন্তী! জয়ন্তী!


  


[দূর হইতে জয়ন্তীর স্বর ভাসিয়া আসিল ‘মীনকেতু।’]


  


যবনিকা

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !