Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Wednesday, December 14, 2016

তৃতীয় অঙ্ক

তৃতীয় অঙ্ক


[গান্ধার রাজ্যের প্রমোদ-প্রাসাদ। মধুশ্রবা, তরুণী কিশোরীর দল, রঙ্গনাথ, কাকলি প্রভৃতি আসীন। মীনকেতু তখনও আসেনি ; বৈতালিক গান।]


[গান]


  



বৈতালিক :

আসিলে কে অতিথি সাঁঝে।



  

পূজার ফুল ঝরে বন-মাঝে।।



  

দেউল মুখরিত বন্দনা-গানে



  

আকাশ-আঁখি চাহে মুখপানে,



  

দোলে ধরাতল দীপ-ঝলমল



  

নৌবতে ভূপালি বাজে।।


  


[হাসিতে হাসিতে মীনকেতুর প্রবেশ। তরুণী ও কিশোরীদলের নৃত্য ও গান]


  


[গান]


  



তরুণী ও কিশোরীরা :

মাধবী-তলে চলো মাধবিকা দল



  

         আইল সুখ-মধুমাস



  

পিককুল কলকল অবিরল ভাষে,



  

         মধুপ মদালস পুষ্প-বিলাসে,



  

           বেণু-বনে ব্যাকুল উছাস।।



  

তরুণ নয়ন-সম আকাশ আ-নীল



  

তট-তরু-ছায়া ধরে নীর নিরাবিল,



  

         বুকে বুকে দীরঘ নিশাস।।


  


[গীত-শেষে কাকলি পরিপূর্ণ সুরার পাত্র আগাইয়া দিল]


  



মীনকেতু :

(সুরার পাত্র নিঃশেষ করিয়া ফিরাইয়া দিয়া) শুধু সুরা নয় কাকলি, সুরার সঙ্গে সুর চাই। তোমার বীণা বিনিন্দিত কণ্ঠের সুর। আজ যে আমার তাকেই দেখার দিন, যাকে কখনও দেখিনি।


  


[গান]


  



কাকলি :

গহিন রাতে –



  

         ঘুম কে এলে ভাঙাতে



  

ফুলহার পরায়ে গলে,



  

         দিলে জল নয়ন-পাতে।।



  

যে জ্বালা পেনু জীবনে



  

ভুলেছি রাতে স্বপনে,



  

কে তুমি এসে গোপনে



  

         ছুঁইলে সে বেদনাতে।।



  

যবে কেঁদেছি একাকী



  

কেন মুছালে আঁখি



  

নিশি আর নাহি বাকি



  

         বাসি ফুল ঝরিবে প্রাতে।।


[সাধারণ নাগরিকের শ্বেত বস্ত্রে সজ্জিত হইয়া তরবারিশূন্য খাপ হস্তে সেনাপতি চন্দ্রকেতুর প্রবেশ]


  



মীনকেতু :

(উঠিয়া পড়িয়া) একী! সেনাপতি? শ্বেত পতাকা জড়িয়ে এসেছ বন্ধু!



চন্দ্রকেতু :

(মীনকেতুর পদতলে তরবারি খাপ রাখিয়া) সম্রাট! আমি আর সেনাপতি নই। আজ হতে আমার নাম শুধু চন্দ্রকেতু। আমার আর সেনাপতিত্ব করবার অধিকার নেই। আমি পরাজিত হয়েছি। পরাজিতের গ্লানি ভুলবার একমাত্র উপায় যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি তাই স্বেচ্ছায় আমি নিজেকে চির-নির্বাসন দণ্ড দিয়েছি। আজ আর আমার মনে কোনো গ্লানি নাই, মৃত্যু-লোকের পথ রুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু আমি অমৃতলোকের পথের দিশা পেয়েছি।



মীনকেতু :

জিজ্ঞাসা করতে পারি কি বন্ধু, তোমার এই অমৃতলোকের পথের দিশারিটি কে?



চন্দ্রকেতু :

আমার, না – একা আমার কেন – সর্বলোকের বিজয়িনী এক নারী। তার নাম আমি করব না। আজ আমি সত্যই বুঝতে পেরেছি সম্রাট, হৃদয়ের রণভূমিতে যে জয়ী হয়, শত যুদ্ধজয়ের সেনাপতির চেয়েও সে বড়ো। হৃদয় জয় করতে না পারার বেদনা আমার বাহুকে যে এমন শক্তিহীন করে তুলবে, এ আমার কল্পনার অতীত ছিল।


  



মীনকেতু :

(চন্দ্রকেতুর পিঠ চাপড়াইয়া) দুঃখ কোরো না বন্ধু, ও পরাজয়ের মধুর আস্বাদ একদিন তোমাদের মীনকেতুকে – এই যৌবনের সম্রাটকেও পেতে হবে! সুন্দর হাতের পরাজয় কি পরাজয়? কিন্তু সেই বিজয়িনীর কাছে তুমি পরাজিত হলে অস্ত্রের যুদ্ধে, না বিনাঅস্ত্রের যুদ্ধে?



চন্দ্রকেতু :

(ম্লান হাসি হাসিয়া) দুই যুদ্ধেই সম্রাট, যদিও ওখানে বিনাঅস্ত্রের যুদ্ধ করতে যাইনি। আমার সৈন্য নিয়ে গৈরিকস্রাবের মতো যশলমিরসৈন্যর উপর গিয়ে পড়লুম। প্রায় পরাজিতও করে এনেছিলুম, এমন সময় আষাঢ়ের মধ্যাহ্ন-সূর্যের মতো দীপ্তি নিয়ে এল জয়ন্তী – যশলমিরের অধীশ্বরী। এতরূপ আমি আর দেখিনি। এইটুকু দেহের আধারে এত রূপ কী করে ধরল, সকল রূপের স্রষ্টাই বলতে পারেন। ও যেন বিশ্বের বিস্ময়। কিন্তু রূপের চেয়েও সুন্দর তার চোখ। ও চোখে যেন সূর্য-চন্দ্র লুকোচুরি খেলছে।



মীনকেতু :

বড়ো বাড়িয়ে বলছ চন্দ্রকেতু। তারপর কি হল বল।



চন্দ্রকেতু :

আমি তখনও সেনাপতি উগ্রাদিত্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে ব্যাপৃত। জয়ন্তী যেমন অপরূপ সুন্দর, উগ্রাদিত্য তেমনই ভীষণ কুৎসিত। ওর শরীরে যেন সকল পশুর সকল দানবের শক্তি। ও যেন নিখিল অসুরের প্রতীক। বুঝলাম, দেবী-শক্তির সঙ্গে দানব-শক্তি মিশেছে এসে। এ শক্তি অপরাজেয়।



মীনকেতু :

(অস্থিরভাবে পায়চারি করিতে করিতে) হাঁ, এখন বুঝতে পেরেছি ও শক্তির উৎস কোথায়?



চন্দ্রকেতু :

হয়তো-বা উগ্রাদিত্যের হাতেই পরাজিত হতুম, কিন্তু সে লজ্জা থেকে বাঁচালে এসে জয়ন্তী। সে উগ্রাদিত্যকে সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে, “তুমি তো এ যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না সেনাপতি ; তুমি ফিরে যাও।” আমি বললুম, “আমি যুদ্ধস্থল থেকে কখনও পরাজয় নিয়ে ফিরিনি।” সে হেসে বললে, “তুমি হৃদয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্ষত-বিক্ষত। আহত সেনানীকে আমার সেনানীর আঘাত করতে বাধে না, কিন্তু আমার বাধে। তোমার চোখ তো সৈনিকের চোখ নয়, ও চোখে মৃত্যু-ক্ষুধা কই, ও যে প্রেমিকের চোখ, হতাশার বেদনায় ম্লান!” আমি যেন এক মুহূর্তে ওই নারীর মনের আরশিতে আমার সত্যকার আহত মূর্তি দেখতে পেলাম। আমার হাত হতে তরবারি পড়ে গেল।



মীনকেতু :

(অভিভূতের মতো) হাঁ, এই সেই! এই সেই বিজয়িনী। আমার যেন মনে পড়ছে স্বর্গে আমি ছিলুম পঞ্চশর, শিবের অভিশাপে এসেছি মর্ত্যলোকে। ওই বিজয়িনী ও জয়ন্তী নয়, ও রতি! (হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া) তা নয়, তা নয়। হাঁ, তারপর চন্দ্রকেতু, তুমি ফিরে এলে? ভ্রষ্ট তরবারি আবার কুড়িয়ে নিলে না?



চন্দ্রকেতু :

ভ্রষ্টা শক্তিকে আর গ্রহণ করিনি। ওকে চিরকালের জন্য ওই রণক্ষেত্রে বিসর্জন দিয়ে এসেছি।



মীনকেতু :

(হাসিয়া উঠিয়া) ভুল করেছ বন্ধু! রামের মতোই রামভুল করে বসেছ! ও শক্তি ভ্রষ্টা নয়, ও সীতার মতোই সতী।




চন্দ্রকেতু :

এইবার তারই অগ্নি-পরীক্ষা হবে! কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও লোকলজ্জায় ওকে গ্রহণ করতে পারব না। আমাদের মাঝে চিরনির্বাসনের যবনিকা পড়ে গেছে।


  



  

[সহসা দশদিক আলোময় হইয়া উঠিল। যশলমির-রাজ্যেশ্বরী জয়ন্তী ও সেনাপতি উগ্রাদিত্যের প্রবেশ ও শঙ্খ তূর্যধ্বনি]


  



জয়ন্তী :

(চন্দ্রকেতুর পানে তরবারি আগাইয়া দিয়ে) না সেনাপতি! ওকে নির্বাসন দিলে রামের মতো তোমারও চরম দুর্গতি হবে। এই ধরো তোমার পরিত্যক্তা শক্তি। আমি অগ্নিশিখা। ওর অগ্নি-শুদ্ধি হয়ে গেছে।



চন্দ্রকেতু :

(বিস্ময়-অভিভূত কণ্ঠে চমকিত হইয়া) সম্রাট! সম্রাট! এই – এই সেই মহীয়সী নারী। এই জয়ন্তী!


  



  

[মীনকেতু তরবারি মোচন করিয়া জয়ন্তীর দিকে এবং জয়ন্তীও মীনকেতুর দিকে অভিভূতের মতো বুভুক্ষু দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিল। দূরে মধুর সুরে বংশী বাজিয়া উঠিল। সহসা মীনকেতুর হাত হইতে তরবারি পড়িয়া গেল। উগ্রাদিত্যের চক্ষু ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতো জ্বলিতে লাগিল।]


  



উগ্রাদিত্য :

রানি, আমি কি এদের বন্দি করতে পারি?



জয়ন্তী :

উগ্রাদিত্য, পরাজিত হলেও ইনি সম্রাট। ওঁর সম্মান রেখে কথা বলো।



উগ্রাদিত্য :

মার্জনা করো রানি, যে পরাজিত হয় তার বন্দি ছাড়া আর কোনো সংজ্ঞা নেই। সম্রাট হলেও সে বন্দি।



জয়ন্তী :

বন্দি করতে হয়, আমি নিজ হাতে বন্দি করব।



মীনকেতু :

তুমি কোন্ পথ দিয়ে এলে রানি?



জয়ন্তী :

তোমার পরাজয়ের পথ দিয়ে সম্রাট! এখন তুমি কি স্বেচ্ছায় বন্দি হবে, না যুদ্ধ করবে?



মীনকেতু :

যুদ্ধ? কার সাথে যুদ্ধ রানি! যেদিন তুমি আমার রাজ্যের সীমান্ত অতিক্রম করেছ, সেদিনই তো আমার পরাজয় হয়ে গেছে।



জয়ন্তী :

শুধু ওইটুকুতেই শেষ হবে না সম্রাট। তোমাকে চরম পরাজয়ের লজ্জা স্বীকার করতে হবে আমার কাছে – নারীর শক্তির কাছে। তোমাকে শিকল পরতে হবে এবং সে শিকল সোনার নয়!



মীনকেতু :

সুন্দর হাতের সোনার ছোঁয়ায় লোহার শিকলই সোনা হয়ে উঠবে। (হাত আগাইয়া) বন্দি করো, রানি!



জয়ন্তী :

কিন্তু বিনা যুদ্ধে তুমি হার মানবে? আমার কাছে না-হয় হার মানলে কিন্তু ওই উগ্রাদিত্য, আমার সেনাপতি – ওর কাছেও কি পরাজয় স্বীকার করবে?



মীনকেতু :

(উগ্রদিত্যকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়া) ও কে? ওকে তো দেখিনি! ও তো এ পৃথিবীর মানুষ নয়।




উগ্রাদিত্য :

(হিংস্র হাসি হাসিয়া) আমি পাতাল-তলের দৈত্য, সম্রাট! আজ তোমাকে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতেই হবে। আজ আমাদের শক্তি পরীক্ষার দিন।



মীনকেতু :

(জ্বলন্ত চোখে উগ্রাদিত্যের দিকে চাহিয়া) হাঁ। ওর সাথে যুদ্ধ করা যায়। ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত অপরাজেয় পৌরুষের পাষাণে মোড়া! হাঁ, সত্যকার পুরুষ দেখলুম! আমার সমস্ত মাংসপেশি ওকে দেখে লোহার মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। শিরায় শিরায় চঞ্চল রক্তের উন্মাদনা জেগে উঠছে। নিশ্চয়ই! তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব সেনাপতি! কিন্তু কী পণ রেখে যুদ্ধ করবে তুমি?



উগ্রাদিত্য :

(হিংস্র আনন্দে উন্মত্ত হইয়া উঠিল। জয়ন্তীকে দেখাইয়া) আমার পণ এই অমৃত-লক্ষ্মী সম্রাট। যার লোভে আমি পাতাল ফুঁড়ে ওই অমৃতলোকে উঠে গেছি শক্তির ছদ্মবেশে। তাকে যদি আজ জয় করতে না পারি তাহলে আমার তোমার হাতে মৃত্যুই তার উপযুক্ত শাস্তি!



জয়ন্তী :

(দৃপ্তকণ্ঠে) উগ্রাদিত্য! তুমি তাহলে ছদ্মবেশী লোভী, শক্তিধর নও।



উগ্রাদিত্য :

আজ আমি সত্য বলব রানি। আমি অসুর-শক্তি নই, আমি লোভ-দানব। আমার বাহুতে যে অমিত শক্তি, তা আমার ওই অপরিমাণ ক্ষুধারই কল্যাণে। আজ আমার সত্য প্রকাশের চরম মুহূর্ত উপস্থিত।



জয়ন্তী :

মিথ্যাচারী! (মীনকেতুর পতিত তরবারি তুলিয়া মীনকেতুর হাতে দিয়া) আর আমার ভয় নেই সম্রাট, তুমি জয়ী হবে। ও শক্তির প্রতীক নয়, ও লোভীর ক্ষুধাজীর্ণ মূর্তি, তোমার এক আঘাতেই ও চূর্ণীকৃত হয়ে যাবে।



উগ্রাদিত্য :

কী সম্রাট, তুমি কি ওই বিক্ষিপ্ত অস্ত্রই গ্রহণ করবে, না রিক্তহস্তে আত্মরক্ষা করবে?



মীনকেতু :

(হাসিয়া) আমি চন্দ্রকেতু নই, উগ্রাদিত্য। আমারই শিথিল মুষ্টির জন্য যে শক্তি পতিত হয়, তাকে আবার হাতে তুলে নিতে আমার লজ্জা নেই। তুমি লোভ-দানব, তোমার উদরে দশ মুখের ক্ষুধা, হস্তে বিশ হস্তের লুণ্ঠন আর প্রহরণশক্তি। তোমার সঙ্গে অহিংসযুদ্ধ করা চলে না। আমি অস্ত্র গ্রহণ করলুম।



উগ্রাদিত্য :

তোমার পণ?



মীনকেতু :

আমারও পণ ওই অমৃত-লক্ষ্মী (মীনকেতু চতুর্থ বার তরবারি আঘাত করিতেই উগ্রাদিত্য পড়িয়া গেল)



জয়ন্তী :

(সহসা কাঁপিয়া উঠিয়া) সম্রাট! মীনকেতু! ও কী করলে তুমি, তোমায় দিয়ে একী করালুম আমি? ও যে আমার শক্তি, লোভ, ক্ষুধা, সব – ওই লোভ, ওই ক্ষুধার শক্তি নিয়েই যে তোমায় জয় করতে বেরিয়েছিলুম। উঃ! মীনকেতু! আজ আমার প্রথম মনে হচ্ছে, আমি রাজ্য শাসনের রানি নই, অশ্রুজলের নারী।


[চন্দ্রিকার প্রবেশ]



চন্দ্রিকা :

একী এ কোথায় এলুম! এই কী অন্ধপতির প্রেমে-অন্ধ গান্ধারীর দেশ। এই কী হৃদয়ের সেই চিররহস্যময় পুরী? ওরা কারা দাঁড়িয়ে? মূক, মৌন, ম্লান। ওই ঙ্গক আলেয়ার পিছনে ঘুরে-মরা চির-পথিকের দল? ওরা সব যেন চেনা! ওদের কোথায় কোন্ লোকে যেন দেখেছি। (পতিত উগ্রাদিত্যকে দেখিযা) ও কে? – দিদি? আর এ কে? অ্যা! উগ্রাদিত্য? এখানে এত রক্ত কেন? (আর্তনাদ করিয়া উঠিয়া) উগ্রাদিত্য! এ কী, কে তোমায় হত্যা করলে? দিদি! দিদি!



মীনকেতু :

(শান্ত স্বরে) দেবী! উগ্রাদিত্যকে আমিই হত্যা করেছি! ও দৈত্য, অমৃত পান করতে এসেছিল! ওই ওর নিয়তি!



জয়ন্তী :

চন্দ্রিকা! উগ্রাদিত্য চলে গেছে আমার সকল শক্তি অপহরণ করে। তুই পারবি চন্দ্রিকা ওকে বাঁচাতে তোর তপস্যা দিয়ে? নইলে আমি বাঁচব না। ওকে বাঁচাতেই হবে।



চন্দ্রিকা :

দিদি! ওকে নিয়ে তোমার চেয়ে আমার প্রয়োজনই যে বেশি। ওকে না বাঁচালে আমাদের পৃথিবী যে চির-সন্ন্যাসিনী হয়ে উঠবে। এর জন্য যদি মৃত্যু-রাজার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে হয়, তাও দাঁড়াব গিয়ে! সাবিত্রীর মতো আমার এই শবের মধ্যে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করার তপস্যা আজ হতে শুরু, আজ হতে আমার নাম হবে কল্যাণী!



জয়ন্তী :

(দাঁড়াইয়া উঠিয়া) আশীর্বাদ করি, তুই রক্ষকুলবধূ প্রমীলার মতো স্বামীসোহাগিনি হয়ে সহমরণ নয়, সহজীবন লাভ কর! (মীনকেতুকে নমস্কার করিয়া) বন্ধু! নমস্কার! আমি তোমায় বন্দী করতে এসেছিলুম হয়তো-বা বন্ধন নিতেও এসেছিলুম। কিন্তু সে বন্ধন আজ ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ছিন্ন হয়ে গেল! উগ্রাদিত্যের মৃত্যুর সাথে সাথে আমার হৃদয়ের সকল ক্ষুধা সকল লোভের অবসান হয়ে গেল। আমি আজ রিক্তা সন্ন্যাসিনী! (একটু থামিয়া) আমি এই সুদূর পৃথিবীতে সন্ন্যাসিনী হতে আসিনি। বধূ হওয়ার, জননি হওয়ার তীব্র ক্ষুধার আগুন জ্বেলে তোমাকে জয় করতে এসেছিলুম। তোমাকেও পেলুম কিন্তু বুকের সে আগুন আমার নিভিয়ে দিয়ে গেল উগ্রাদিত্য!



মীনকেতু :

জয়ন্তী! তুমিও কি তবে ওকে ভালোবাসতে? তাহলে জয় করেও কি আমার পরাজয় হল? উগ্রাদিত্য মরে হল জয়ী! যাকে পণ রেখে জয় করলুম – সে কি আপন হল না?



জয়ন্তী :

কায়াহীন ভালোবাসা নিয়ে যারা তৃপ্ত হয়, তুমি তো তাদের দলের নও মীনকেতু। তুমি চাও জয়ন্তীকে, এই মুহূর্তের রিক্তাকে নিয়ে তুমি সুখী হতে পারবে না। যে তেজ যে দীপ্তির জোরে তোমায় জয় করলুম – সেই তো ছিল উগ্রাদিত্য। তোমার হাতে তার পতন হয়ে গেছে! বন্ধু! বিদায়!



মীনকেতু :

(আর্তকণ্ঠে) জয়ন্তী! আর কী তবে আমাদের দেখা হবে না?



জয়ন্তী :

হয়তো হবে, হয়তো-বা হবে না! যদি আমার মনে আবার সেই ক্ষুধা জাগে, যদি ওই উগ্রাদিত্য প্রাণ পায়, কল্যাণীর সিঁথিতে সিঁদুর ওঠে, আমি আবার আসব। সেনাপতি নমস্কার!


[প্রস্থান]



মীনকেতু :

(উন্মাদের মতো চিৎকার করিয়া উঠিল) জয়ন্তী! জয়ন্তী!


  


[দূর হইতে জয়ন্তীর স্বর ভাসিয়া আসিল ‘মীনকেতু।’]


  


যবনিকা

দ্বিতীয় অঙ্ক

দ্বিতীয় অঙ্ক


[সেনাপতি উগ্রাদিত্যের প্রবেশ। চোখে মুখে অস্বাভাবিক ভীষণতা। কণ্ঠে, চলাফেরায়, ব্যবহারে বর্বর বন্য পশুকে স্মরণ করাইয়া দেয়। ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মতো চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া, বুকের তলা হইতে ‘বাঘনখ’ অস্ত্র বাহির করিয়া সে এক মনে দেখিতে লাগিল। দূরে চন্দ্রিকার গান শুনিতেই চমকিয়া উঠিল।]


[গান করিতে করিতে চন্দ্রিকার প্রবেশ]


  


[গান]


  



চন্দ্রিকা :

এ নহে বিলাস বন্ধু ফুটেছি জলে কমল।



  

এ যে ব্যথা-রাঙা হৃদয় আঁখিজলে টলমল।।



  

কোমল মৃণাল দেহ ভরেছে কন্টক-ঘায়,



  

শরণ লয়েছি গো তাই শীতল দিঘির জল।।



  

ডুবেছি অতল জলে কত যে জ্বালা সয়ে



  

শত ব্যথা ক্ষত লয়ে হইয়াছি শতদল।।



  

আমার বুকের কাঁদন, তুমি বল ফুল-বাস,



  

ফিরে যাও, ফেলো না গো শ্বাস,



  

             দখিনা বায়ু চপল।।


  



চন্দ্রিকা :

এ কী, সেনাপতি! লুকিয়ে আমার গান শুনছিলে বুঝি?



উগ্রাদিত্য :

(কর্কশ কণ্ঠে মুখ বিকৃত করিয়া) গান আমি কারুরই শুনিনে চন্দ্রিকা। আমি গাধার চিৎকার দশঘন্টা ধরে শুনতে পারি, কিন্তু মানুষের চিৎকার – হ্যাঁ চিৎকার বইকি, তা তোমরা তাকে হয়তো গান বলে থাক – এক মুহূর্তও শুনতে পারিনে।



চন্দ্রিকা :

বল কী উগ্রাদিত্য! গান হল চিৎকার? আর গাধার ডাক হল তোমার কাছে মানুষের – মানে আমার গানের চেয়েও সুন্দর? হলই বা ওরা তোমার আত্মীয়, তাই বলে কি এতটা পক্ষপাত করতে হয়?



উগ্রাদিত্য :

দেখ চন্দ্রিকা, তুমি যে কীসব কথা বল প্যাঁচ দিয়ে, আমি তার মানে বুঝি না, অবশ্য বুঝবার দরকারও নেই আমার। তোমার চলন বাঁকা, তোমার চোখের চাউনি বাঁকা, তোমার কথা বাঁকা!



চন্দ্রিকা :

অর্থাৎ আমি অষ্টাবক্র মুনি, এই তো! (গান করিয়া) “বাঁকা শ্যাম হে, বাঁকা তুমি, বাঁকা তোমার মন!”



উগ্রাদিত্য :

উঃ, মানুষদের কত বেশি মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটলে এমন সুর করে চ্যাঁচাতে পারে। একরোখা চ্যাঁচানোর মানে বুঝি, তা সওয়া যায়, কিন্তু এই একবার জোরে, একবার আস্তে, একবার নাকি সুরে চ্যাঁচানো শুনে এমন রাগ ধরে!



চন্দ্রিকা :

এও আবার লোকে আদর করে শোনে! এত পাগলও আছে পৃথিবীতে! ভাগ্যিস তোমার মতো আরও দু-চারটি পাথুরে মস্তিষ্কের লোক নেই পৃথিবীতে, নইলে পৃথিবীটা এতদিন চিড়িয়াখানা হয়ে উঠত উগ্রাদিত্য! – (চমকিয়া) ও কী! তুমি অমন করে বাঘ-নখ ধরেছ কেন? তোমার চোখে হিংস্র বাঘের মতো অমন দৃষ্টি কেন? সাপ যেমন করে শিকারের দিকে তাকায়, – না আমার কেমন ভয় করছে। আমি পালাই!


[ছুটিয়া পলায়ন]


[চন্দ্রিকার হাত ধরিয়া জয়ন্তীর প্রবেশ]


  



জয়ন্তী :

কীরে, তুই অমন করে ছুটছিলি কেন? ভূত দেখলি নাকি?



চন্দ্রিকা :

(ভয়-জড়িত কণ্ঠে) হাঁ! না দিদি, ভূত নয়, বাঘ! নেকড়ে বাঘ!



জয়ন্তী :

বাঘ? কোথায় দেখলি?



চন্দ্রিকা :

(উগ্রাদিত্যকে দেখাইয়া) ওই দাঁড়িয়ে! হালুম! ওই দেখ, হাতে বাঘ-নখ! বাঘের মতো গোঁফ, চোখ, মুখ, শুধু ল্যাজটা হলেই ও পুরোপুরি বাঘ হয়ে যেত!



জয়ন্তী :

তুই বড়ো দুষ্টু চন্দ্রিকা! ওর পেছনে দিনরাত অমন করে ফেউলাগা হয়ে লেগে থাকলে ও তাড়া করবে না?



চন্দ্রিকা :

ফেউ কী সাধে লাগে দিদি? ফেউ ডাকে বলেই তো দেশের শিকারগুলো এখনও বেঁচে আছে। নইলে তোমার বাঘ এতদিন দেশ সাবাড় করে ফেলত।



জয়ন্তী :

কিন্তু, ও তো আমার কাছে দিব্যি শান্ত হয়ে থাকে। ওই দেখ না ওর বাঘ-নখ ওর বুকের ভিতর নিয়ে লুকিয়েছে!



চন্দ্রিকা :

কী জানি দিদি, ঘোড়ার লাথি ঘোড়াই সইতে পারে! ও তোমার পোষা বাঘ কি না!



জয়ন্তী :

উগ্রাদিত্য!



উগ্রাদিত্য :

(তরবারি-মুষ্টি ললাটে ঠেকাইয়া অভিবাদন করিয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল)।



জয়ন্তী :

(চন্দ্রিকার দিকে তাকাইয়া) দেখলি চন্দ্রিকা, ও আজ আমার কাছে মাথা হেঁট করে অভিবাদন করলে না। ললাটে তরবারি ছুঁইয়ে সম্মান দেখালে। ও বলে, ওর শির ভূমিস্পর্শ করতে পারে শুধু তারই খড়্গে, যে ওকে পরাজিত করবে।



চন্দ্রিকা :

সে মহাষ্টমী কখন আসবে দিদি! আমার বড্ড সাধ, মহিষ-মর্দিনীর পায়ে মহিষ-বলি দেখব!



জয়ন্তী :

ছি চন্দ্রিকা! তুই বড্ড প্রগল্‍ভা হয়েছিস। উগ্রাদিত্য, তুমি এখন যাও, আমি দরকার হলে ডাকব। আর দেখো, চন্দ্রিকার উপর রাগ কোরো না। মনে রেখো, ও আমারই ছোটো বোন।



উগ্রাদিত্য :

জানি রানি! (আবার ললাটে তরবারি ছোঁয়াইয়া অভিবাদন করিয়া চন্দ্রিকার দিকে অগ্নি-দৃষ্টিতে তাকাইয়া চলিয়া গেল।)



জয়ন্তী :

আচ্ছা চন্দ্রিকা! এই যে ওকে রাতদিন অমন করে খেপাস, ধর ওরই সাথে যদি তোর বিয়ে হয়!



চন্দ্রিকা :

বাঃ, দিদির চমৎকার পছন্দ তো! এ মুক্তোর মালা অমনই জীবের গলায় তো ঠিক ঠিক মানাবে।... আচ্ছা দিদি, ও অত নিষ্ঠুর কেন? যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেছি, ও আহত সৈনিককেও হত্যা করতে ছাড়ে না! ও যেন বনের পশু। আদিম কালের বর্বর!



জয়ন্তী :

ও সত্যই মৃত্যুর মতো মমতাহীন। তাই ও জ্যান্ত আহত কারুর প্রতি কোনো মমতা দেখায় না। ওকে মারতে হবে – এইটাই ওর কাছে সত্য। ওই হচ্ছে পরিপূর্ণ পুরুষ, চন্দ্রিকা। ওর মাঝে একবিন্দু মায়া নেই, করুণা নেই। ওর এক তিলও নারী নয়! – পশু, বর্বর, নির্মম পুরুষ!



চন্দ্রিকা :

(হঠাৎ অন্যমনস্ক হইয়া গান করিতে লাগিল)


[গান]


  


বেসুর বীণায় ব্যথার সুরে বাঁধব গো।।


পাষাণ বুকে নিঝর হয়ে কাঁদব গো।।


কুলের কাঁটায় স্বর্ণলতার দুলব হার,


ফণির ডেরায়, কেয়ার কানন ফাঁদব গো।।


ব্যাধের হাতে শুনব সাধের বংশি-সুর


আসলে মরণ চরণ ধরে সাধব গো।।


বাদল-ঝড়ে জ্বালব দীপ বিদ্যুৎলতার,


প্রলয়-জটায় চাঁদের বাঁধন ছাঁদব গো।।


  



জয়ন্তী :

আচ্ছা চন্দ্রিকা, সত্যি করে বল দেখি, ওর ওপর তোর এত আক্রোশ কেন? ওকে দেখতেও পারিসনে আবার ভুলতেও পারিসনে। ঘৃণা করার ছলে যে ওকে নিয়েই তোর মন ভরে উঠল।



চন্দ্রিকা :

(চমকিয়া উঠিয়া) সত্যিই তো দিদি, এমনি করেই বুঝি সাপের ছোবলে সাপুড়ের, বাঘের হাতে শিকারির মৃত্যু হয়। (একটু ভাবিয়া) তা ও-সাপ যদি নাচাতেই হয় আমাকে, ওর বিষ-দাঁতগুলো আগে ভেঙে দেব!



জয়ন্তী :

ছি, ছি, শেষে ঢোঁড়া নিয়ে ঘর করবি?



চন্দ্রিকা :

বিষ গেলে ওর কুলোপনা চক্র থাকবে তো। ফোঁস-ফোঁসানি থাকলেই হল, লোকে মনে করবে জাত-গোখরো। (চলিয়া যাইতে যাইতে ) সত্যি দিদি, আমার দিনরাত কেবলই মনে হয় ও কেন অমন বন্যপশু হয়ে থাকবে? ওকে কি লোকালয়ে মানুষ করে তোলার কেউ নেই? বড়ো দয়া হয় ওকে দেখলে। ও যেন সব চেয়ে নিরাশ্রয়, একা! ওর বন্ধু সাথি কেউ নেই! ওই পাথুরে পৌরুষকে নারীত্বের ছোঁয়া দিয়ে মুক্তি দিলে হয়তো মহাপুরুষ হয়ে উঠবে।



জয়ন্তী :

হ্যাঁ, দস্যু রত্নাকর হঠাৎ বাল্মীকি মুনি হয়ে উঠবেন!



চন্দ্রিকা :

বিচিত্র কি দিদি! সত্যি, বলো তো, কেন এমন হয়? ও কেন এমন বর্বর হল শুধু এই চিন্তাটাই আমাকে এমন পীড়া দেয়। ওকে কেন এমন করে পীড়ন করি? বেচারা বুনো! (হাসিয়া উঠিয়া) এক একবার এমন হাসি পায়! মনে হয় আমার সমস্ত শরীরটা দাঁত বের করে হাসছে।


  


[গান]


  


তাহারে দেখলে হাসি, সে যে আমার দেখন-হাসি,


(ওগো) আমি কচি, সে যে ঝুনো, আমি উনিশ


 সে ঊন-আশি।।


সে যে চিল আমি ফিঙে, আমি বাঁট সে যে ঝিঙে।


আমি খুশি সে যে খাসি, সে যে বাঁশ আমি বাঁশি।


ও সে যত রাগে, অনুরাতে পরাই গলে তত ফাঁসি।।


  



জয়ন্তী :

তুই তোর বাঁদরের চিন্তা কর! আমি চললুম, আমার অনেক কাজ আছে। (প্রস্থানোদ্যত)



চন্দ্রিকা :

আচ্ছা দিদি, আমি কি তোমার কোনো কিছু জানবার অধিকারী নই? তোমার অনেক কাজ আছে বললে, কিন্তু ওই অনেক কাজের একটা কাজেও তো সাহায্য করতে ডাকলে না আমায়!



জয়ন্তী :

(চন্দ্রিকার মাথায় গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে) পাগল! সবাই কি সব কাজের উপযুক্ত হয়! তোর প্রতি পরমাণুটি নারী, তাই শুধু হৃদয়ের ব্যাপার নিয়েই মেতে আছিস। আমার মধ্যে নারীত্ব যেমন, পৌরুষও তেমনই। তাই আমি এখন হাতে যেমন তরবারি ধরেছি, তেমনই সময় এলে চোখে বাণও হয়তো মারব। তুই আগাগোড়া নারী বলেই এই পা থেকে মাথা পর্যন্ত পশু উগ্রাদিত্যের এত চিন্তা করিস। আর আমি অর্ধ-নারী বলে পুরুষালি রাজ্যের চিন্তা নিয়ে মরি। তাই তুই হয়েছিস নারী, আর আমি হয়েছি রানি।



চন্দ্রিকা :

(রাগ করিয়া চলিয়া যাইতে যাইতে) তুমি যা না তাই বলছ দিদি আমায়! আমার মরণ নেই তাই গেলুম ওই বুনো জানোয়ারটাকে ভালোবাসতে। আমি চললুম ফের তোমার বাঘকে খোঁচাতে।


[প্রস্থান]


  



জয়ন্তী :

ওরে যাসনে। আঁচড়ে-কামড়ে দেবে হয়তো।... (ওই পথে চাহিয়া থাকিয়া) পাগল! বদ্ধ পাগল!


  


[উগ্রাদিত্যের প্রবেশ]


  



উগ্রাদিত্য :

আমার মনে ছিল না সম্রাজ্ঞী, আজ আমাদের অগ্নি-উৎসবের রাত্রি।



জয়ন্তী :

আমার মনে আছে সেনাপতি। কিন্তু এবার এ নৃত্যে যোগদান করব শুধু আমি আর আমার যোগিনীদল। তুমি আমার সব সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ওই পার্বত্য-গিরিপথ রক্ষা করবে। আমাদের এই উৎসবের সুযোগ নিয়ে শত্রুরা যেন আমাদের আক্রমণ করতে না পারে।


  


[উগ্রদিত্যের পূর্বরূপ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান]


  



জয়ন্তী :

কোথায় লো যোগিনীদল! আয়, আজ যে আমাদের অগ্নিবাসর।


  


[গান করিতে করিতে অগ্নিশিখা রঙের বেশভূষার সজ্জিত হইয়া যোগিনীদলের প্রবেশ]


  


[গান]


  



যোগিনী দল :

জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।।



  

জাগো স্বাহা সীমান্ত রক্ত-টিকা।।



  

      দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা



  

      নেচে চলো উন্মাদিনী দিগ্‌বসনা,



  

      জাগো হতভাগিনি ধর্ষিতা নাগিনি



  

            বিশ্ব-দাহন-তেজে জাগো দাহিকা।।



  

ধু ধু জ্বলে ওঠো ধূমায়িত অগ্নি!



  

জাগো মাতা কন্যা বধু জায়া ভগ্নী!



  

      পতিতোদ্ধারিণী স্বর্গ-স্খলিতা



  

      জাহ্নবী সম বেগে জাগো পদ-দলিতা।



  

      চির-বিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা।।


  



জয়ন্তী :

আমি আগুন, তোরা সব আমার শিখা! আজ ফাল্গুন-পূর্ণিমা – আমার জন্মদিন। আগুনের জন্মদিন। এমনই ফাল্গুন-পূর্ণিমায় প্রথম নারীর বুকে প্রথম আগুন জ্বলেছিল। সে আগুন আজও নিবল না! কত ঘরবাড়ি বন কান্তার মরুভূমি হয়ে সে অগ্নিক্ষুধার ইন্ধন হল, তবু তার ক্ষুধা আর মিটল না। ও যেন পুরুষের বিরুদ্ধে প্রকৃতির যুদ্ধ-ঘোষণার রক্ত-পতাকা। নরের বিরুদ্ধে নারীর নিদারুণ অভিমান-জ্বালা।



[গান]


  



যোগিনী দল :

জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা



  

জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা।।


  



জয়ন্তী :

হাঁ, মীনকেতু গর্ব করে ঘোষণা করেছিল, সে নিখিল পুরুষের প্রতীক। যৌবন-সাম্রাজ্যের সম্রাট। ফুল আর হৃদয় দলে চলায় নাকি ওর ধর্ম। ওকে আমি জানাতে চাই যে, যৌবন শুধু পুরুষেরই নাই। ওদের যৌবন আসে ঝড়ের মতো, তুফানের মতো বেগে ; নারীর যৌবন আসে অগ্নিশিখার মতো রক্তদীপ্তি নিয়ে। আমি জানতে চাই, পুরুষের পৌরুষ দুর্দান্ত যৌবনকে যুগে যুগে নারীর যৌবনই নিয়ন্ত্রিত করেছে। নারীর হাতের লাঞ্ছনা-তিলকই ওদের নিরাভরণ রূপকে সুন্দর করে অপরূপ করে তুলেছে। মীনকেতু যদি হয় নিখিল পুরুষের প্রতীক, আমিও তাহলে নিখিল নারীর বিদ্রোহ ঘোষণা – তার বিরুদ্ধে – নিখিল পুরুষের বিরুদ্ধে।


  


[যোগিনীগণের অগ্নিনৃত্য]


  


[গান]



যোগিনী দল :

জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা –


  


[দূরে তূর্য-নিনাদ, সৈনিকদলের পদধ্বনি, জয়ধ্বনি ও গান]


  



জয়ন্তী :

ওই উগ্রাদিত্য চলেছে আমার অজেয় মরুসেনা নিয়ে। চলো আমরা দূরে দাঁড়িয়ে ওদের জয়-যাত্রার ওই অপরূপ শোভা দেখি গিয়ে। বিরাট-সুন্দরকে দেখতে হলে দূর থেকেই দেখতে হয়, নইলে ওর পরিপূর্ণ রূপ চোখে পড়ে না।


  


[জয়ন্তী ও যোগিনীদলের প্রস্থান]


[গান ও মার্চ করিতে করিতে যশলমির-সেনাদলের প্রবেশ]


  



  

টলমল টলমল পদভরে –



  

বীরদল চলে সমরে।।



  

খর-ধার তরবার কটিতে দোলে,


  



  

রণন ঝনন রণ-ডঙ্কা বোলে।



ঘন

তূর্য-রোলে শোক মৃত্যু ভোলে,



দেয়

আশিস সূর্য সহস্র করে।।



চলে

শ্রান্ত দূর পথে



মরু

দুর্গম পর্বতে



  

      চলে বন্ধু-বিহীন একা



মোছে

রক্তে ললাট-কলঙ্ক-লেখা!



কাঁপে

মন্দিরে ভৈরবী একী বলিদান,



জাগে

নিঃশঙ্ক ত্যজিয়া শ্মশান!



  

বাজে ডম্বরু, অম্বর কাঁপিছে ডরে।

প্রথম অঙ্ক

প্রথম অঙ্ক


[গান্ধার-রাজের প্রমোদ-উদ্যান ও দরদালান, পশ্চাতে পর্বতমালা। পর্বতগাত্র বাহিয়া ঝরনাধারা বহিয়া যাইতেছে। অনতিদূরে দেখা যাইতেছে গান্ধার রাজপ্রাসাদ – রুধির-পালঙ্ক প্রস্তরের ... রাত্রি ভোর হইয়া আসিতেছে। পর্বত-চূড়ায় পাণ্ডুর-গণ্ড কৃষ্ণা সপ্তমীর চাঁদ। ধীরে ধীরে উষার রক্তিমাভা ফুটিয়া উঠিতেছে। ঝরনাধারায় সেই রং প্রতিফলিত হইয়া গলিত রামধনুর মতো সুন্দর দেখাইতেছে। ... প্রমোদ-উদ্যানের অলিন্দে বাহু উপাধান করিয়া নিশি-জাগরণ-ক্লান্ত সম্রাটের প্রমোদ-সঙ্গিনী তরুণীরা-কিশোরীরা স্খলিত অঞ্চলে ঘুমাইতেছে। সহসা রাজপুরীর তোরণদ্বারে প্রভাতি সুরে বাঁশি ফুকারিয়া উঠিল। ঘুমন্ত তরুণীর দল সচকিত হইয়া জাগিয়া উঠিয়া তন্দ্রালস করে তাহাদের বসনভূষণ সংবৃত করিতে লাগিল।]


[ভোরের হাওয়ার গান ও নৃত্য করিতে করিতে প্রবেশ]


  


[গান]


  



ভোরের হাওয়া :

পোহাল পোহাল নিশি      খোলো গো আঁখি।



  

      কুঞ্জ-দুয়ারে তব ডাকিছে পাখি।।



  

ওই বংশী বাজে দূরে      শোনো ঘুম-ভাঙানো সুরে,



  

      খুলি দ্বার বঁধুরে লহো গো ডাকি।।



  

                                        [প্রস্থান]


  


[গান]


  



সুন্দরীরা :

ভোরের হাওয়া, এলে ঘুম ভাঙাতে কি



  

               চুম হেনে নয়ন-পাতে।



  

ঝিরি ঝিরি ধীরি ধীরি কুণ্ঠিত ভাষা



  

               গুণ্ঠিতারে শুনাতে।।



  

হিম-শিশিরে মাজি তনুখানি



  

ফুল-অঞ্জলি আনো ভরি দুই পাণি,



  

ফুলে ফুলে ধরা যেন ভরা ফুলদানি –



  

               বিশ্ব-সুষমা-সভাতে।।


  


[সহসা শঙ্খধ্বনি শোনা গেল। প্রধানা গায়িকা কাকলি গান করিতে করিতে চলিয়া গেল।]


  


[গান]


  



কাকলি :

ফুল কিশোরী। জাগো জাগো, নিশি ভোর।



  

দুয়ারে দখিন-হাওয়া – খোলো খোলো পল্লব-দোর।।



  

জাগাইয়া ধীরে ধীরে    যৌবন তনু-তীরে



  

            চলে যাবে উদাসী কিশোর।।



  

                                        [প্রস্থান]


  


[গান]


  



সুন্দরীরা :

চিনি ও নিঠুরে চিনি



  

পায়ে দলে মন জিনি



  

ভেঙো না ভেঙো না ঘুম-ঘোর।



  

মধুমাসে আসে সে যে ফুলবাস-চোর।।


[একটু পরেই হাসিতে হাসিতে সম্রাট মীনকেতু ও পশ্চাতে সভাকবি মধুশ্রবার প্রবেশ।]


  



মীনকেতু :

(তরুণী কিশোরীদের কাহারও গালে, কাহারও অধরে তর্জনী দিয়া মৃদু টোকা দিতে দিতে, কাহারও খোঁপা খুলিয়া দিয়া, কাহারও বেণি ধরিয়া টানিয়া ফেলিতে ফেলিতে সতৃষ্ণ নয়নে চাহিয়া) সুন্দর! কেমন কবি?



কবি :

শুধু সুন্দর নয় সম্রাট, অপরূপ! ওই লতার ফুল সুন্দর, কিন্তু এই রূপের ফুলদল অপরূপ!



মীনকেতু :

(কবির পিঠ চাপড়াইয়া) সাধু কবি, সাধু! সত্যই এ অপরূপ! – জান কবি, এঁদের সকলেই আমাদের স্বদেশিনী নন, এঁরা শত দেশের শতদল। আমার প্রমোদ-কাননে এঁদের সংগ্রহ করিছি বহু অনুসন্ধান করে। (পশ্চাতে পর্বতগাত্রে প্রবাহিতা ঝরনা দেখাইয়া) পশ্চাতে ওই উদ্দাম জলপ্রপাত, আর সম্মুখে এইরূপ যৌবনের উচ্ছল ঝরনাধারা – মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি, তৃষ্ণার্ত ভোগলিপ্সু পুরুষ, যৌবনের দেবতা। (পায়চারি করিতে করিতে) আমি চাই – আমি চাই –



কবি :

‘আমরা জানি মাতাল হয়ে পাতাল পানে ধাওয়া’ –



মীনকেতু :

হাঁ, ঠিক বলেছ কবি, চোখ পুরে রূপ চাই, পাত্র পুরে সুরা চাই। (হঠাৎ হাসিয়া তরুণী ও কিশোরীদের কাছে গিয়া) তুই কে রে? – বসরা গোলাব বুঝি? বাঃ, যেমন রং তেমনই শোভা, ঠোঁটে গালে লাল আভা যেন ঠিকরে পড়ছে। ... তুই – তুই বুঝি ইরানি নার্গিস? ... হাঁ, নার্গিস ফুলের পাপড়ির মতোই তোর চোখ! ভুরু তো নয়, যেন বাঁকা তলোয়ার; আর তার নীচেই ওই চকচকে চোখ যেন তলোয়ারের ধার! ওঃ, তাতে আবার কালো কাজলের শাণ দেওয়া হয়েছে! একবার তাকালে আর রক্ষে নেই! (বুকে হাত দিয়া) একবারেই ইস্‌পার উস্‌পার! (অন্য দিক দিয়া) আহা, তুমি কে সুন্দরী? তুমি বুঝি বঙ্গের শেফালি! (কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ) শেফালি ফুলের মতোই তোমার শোভা, শেফালি-বৃন্তের মতোই তোমার প্রাণ বেদনায় রাঙা! – আর তুমি? তুমি বুঝি সুদূর চিনের চন্দ্রমল্লিকা? তোমার এত রূপ, কিন্তু তুমি অমন ভোরের চাঁদের মতো পাণ্ডুর কেন? অ! তোমার বুঝি এদেশে মন টিকছে না? – তা কী করবে বল, টিকতেই হবে, না টিকে উপায় নাই! আমি যে তোমাদের চাই! গাও, গাও, মন টেকার গান গাও! যে-গান শুনে সকাল বেলার ফুল বিকেল বেলার কথা ভুলে যায়, ভোরের নিশি সূর্যোদয়ের কথা ভোলে; বনের পাখি নীড়ের পথ ভোলে – সেই গান।


[গান]



সুন্দরীরা :

যৌবন-তটিনী ছুটে চলে ছল ছল



  

ধরণির তরণি টলমল টলমল।।



  

        কূলের বাঁধন খোল



  

        আয় কে দিবি রে দোল,



  

প্রাণের সাগরে রোল ওঠে ওই কল কল।।



  

তটে তটে ঘট-কঙ্কণে নট-মল্লারে ওঠে গান,



  

        মুখে হাসি বুকে শ্মশান।



  

আজিও তরুণী ধরা রঙে রূপে ঝলমল,



  

        রূপে রসে ঢলঢল।।


  


[ম্লানমুখে কৃষ্ণার প্রবেশ]


  



মীনকেতু :

ও কে? কৃষ্ণা? প্রধানা মন্ত্রী – তারপর, এমন অসময়ে এখানে যে!



কৃষ্ণা:

বিশেষ প্রয়োজনীয় রাজকার্যে আপনার আনন্দের বাধা হয়ে এসেছি, সম্রাট!



  

[সভাকবি এতক্ষণ এক ফুল হইতে আর এক ফুলের কাছে গিয়ে কী যেন দেখিতেছিলেন, কৃষ্ণার স্বর শুনিয়া চমকিয়া উঠিলেন]



কবি :

এ ফুল-সভায় তো রাজসভার মন্ত্রীর আসার কথা নয়, দেবী!



মীনকেতু :

(হাসিয়া) ঠিক বলেছ কবি, যেমন আমি এখানে এসেছি মীনকেতু হয়ে – সম্রাট হয়ে নয়।



কৃষ্ণা :

আমিও ফুলবনে আসি, কবি! তবে তোমাদের মতো আয়োজনের আড়ম্বর নিয়ে আসিনে। আমি কৃষ্ণা, নিশীথিনী! আমি নীরবে আসি, নীরবে যাই! হয়তো-বা আমার চোখের শিশিরেই তোমাদের কাননের ফুল ফোটে!‌ (সম্রাটের দিকে তাকাইয়া) আমি তাহলে যেতে পারি, সম্রাট!



মীনকেতু :

রাজ্যের ব্যাপার রাজসভাতেই বোলো কৃষ্ণা, এখানে নয়। কিন্তু! এসেছ যখন, গায়ে একটু ফুলেল হাওয়ার ছোঁয়াচ ন-হয় লাগিয়েই গেলে। ওঃ, ভুলে গিয়েছিলুম, ওতে বোধ হয় তোমার মন্ত্রিত্বের মুখোশটা খুলে কৃষ্ণার মুখোশ বেরিয়ে পড়বে! রাত্রির আবরণ খুলে চাঁদের আভা ফুটে উঠবে।



কৃষ্ণা :

(ধীর স্থির কণ্ঠে) সম্রাটের কি এটা জানা উচিত নয়, যে, তাঁর সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সাথে এই নটীদের সামনে এই ব্যবহার আমাদের সকলেরই মহিমাকে খর্ব করে।


[সম্রাটের ইঙ্গিতে তরুণী ও কিশোরীর দল অভিনন্দন করিয়া চলিয়া গেল।]


  



মীনকেতু :

(কৃষ্ণার হাত ধরিয়া) ওরা নটী নয়, কৃষ্ণা, ওরা আমার প্রমোদসহচরী। আমি রাজার মহিমার মুখোশ খুলে এ প্রমোদ-কাননে আসি ওদের নিয়ে আনন্দ করতে।



কৃষ্ণা :

(হস্ত ছাড়াইয়া লইয়া) আমি জানি সম্রাট, যে, নারী জাতিকে অবমাননা করবার জন্যই আমায়, একজন নারীকে – আপনার রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে বিদ্রুপ করেছেন, অথবা এ হয়তো আপনার একটা খেয়াল! কিন্তু সম্রাট, আপনার যা খেলা, তা হয়তো অন্যের মৃত্যু!



মীনকেতু :

(হাসিয়া) তুমি যে আজকাল একটুকু রহস্যও সহ্য করতে পার না কৃষ্ণা। যে দাড়িভরা হাঁড়িমুখের ভয়ে দেশ থেকে বুড়োগুলোকে তাড়ালুম , তারা দেখচি দল বেঁধে তোমার মনে আশ্রয় নিয়েছে। তোমার মুখের দিকে তাকাতে আমার ভয় হচ্ছে, মনে হচ্ছে চোখ তুলতেই দেখব, তোমার মুখে দাড়ির বাজার বসে গেছে।



কবি :

বুড়োর দাড়ি এমনি করেই প্রতিশোধ নেয় সম্রাট। মুখের দাড়ি মনে গিয়ে বোঝা হয়ে ওঠে।


[গান]


এসেছে নবনে বুড়ো যৌবনেরই রাজ-সভাতে।


কুঁজো-পিঠ বই বয়ে হায় কলম-ধরা ঠুঁটো হাতে।


ভরিল সৃষ্টি এবার দৃষ্টি খাটো যষ্টি-ধরা জ্যেষ্ঠতাতে।


নাতি সব সুপ্‌পনখার নাকি কথার ভূশণ্ডি মাঠ


        আঁধার রাতে।


দাওয়াতে টানতে হুঁকো, উনুন-মুখো,


    নড়েও নাকো ন্যাজ মলাতে।


ভাই সব বলো হরি, কলসি দড়ি, ঝুলিয়েছে


      নিজেই গলাতে।।


  



মীনকেতু :

(হাসিয়া) সত্য বলেছ মধুশ্রবা, বৃদ্ধত্ব আর সংস্কারকে তাড়ানো তত সহজ নয় দেখছি। ওরা কোন্ সময় যে শ্রীজ্ঞানামৃত বিতরণের লোভ দেখিযে তরুণ-তরুণীর মন জুড়ে বসে, তা দেবা ন জানন্তি। আমি যৌবনের হাট বসাব বলে সাম্রাজ্যের বাইরে পিঁজরাপোল করে বুড়ো মনের লোকগুলোকে রেখে এলুম, তারা কি আবার ফিরে আসতে আরম্ভ করেছে? (কৃষ্ণার পানে তাকাইয়া) দেখো কৃষ্ণা, আমি তরুণীদের কাছে কিছুতেই গম্ভীর হতে পারিনে। সুন্দরের কাছে রাজমহিমা দেখানোর মতো হাসির জিনিস আর কিছু কি আছে? ধরো, এই ফোটা ফুলের আর ওইসব উন্মুখ-যৌবনা কিশোরীদের কাছে এমন সুন্দর সকালটা যদি রাজ্যের কথা কয়ে কাটিয়ে দিই – ও কী কৃষ্ণা, হাসছ?



কৃষ্ণা :

মার্জনা করবেন সম্রাট! আমিও আপনার ওই আনন্দ হাসির তরঙ্গের মাঝে মাঝে ভেসে যাই, ভুলে যাই আপনি আমাদের মহিমান্বিত সম্রাট ; আর আমি তাঁর প্রধানমন্ত্রী। (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া) মনে হয় আপনি আমার সেই ভুলে-যাওয়া দিনের শৈশব-সাথি!



কবি :

সম্রাট, একজনের মুখ যখন আর একজনের কর্ণমূলের দিকে এগিয়ে আসে, তখন লজ্জার দায় এড়াতে তৃতীয় ব্যক্তির সেখান থেকে সরে পড়াই শোভন এবং রীতি।



মীনকেতু :

(হাসিয়া কবির দিকে তাকাইয়া থাকিয়া – কৃষ্ণার পানে ফিরিয়া) তুমি আমায় জান কৃষ্ণা, আমি সিংহাসনে যখন বসি, তখন আমি ওই – কেবল তোমারা যা বল – মহিমময় সম্রাট, যুদ্ধক্ষেত্রে যখন যুদ্ধ করি তখন আমি রক্ত-পাগল সেনানী, কিন্তু সুন্দর ফুলবনে আমিও সুন্দরের ধেয়ানী, হয়তো-বা কবিই। যেখানে শুধু তুমি আর আমি, সেখানে তুমি আমায় সেই ছেলেবেলার মতো করেই ডাক-নাম ধরে ডেকো!



কৃষ্ণা :

জানি না, তুমি কী! এতদিন ধরে তো তোমায় দেখেছি, তবু যেন তোমায় বুঝতে পারলুম না। আকাশের চাঁদের মতোই তুমি সুদূর, অমনই জ্যোৎস্নায় কলঙ্কের মাখামাখি।



মীনকেতু :

তবুও ওই সুদূর কলঙ্কী-ই তো পৃথিবীর সাত সাগরকে দিবা-রাত্রি জোয়ার-ভাঁটার দোল খাওয়ায়!



কৃষ্ণা :

সত্যিই তাই। এমনই তোমার আকর্ষণ। (একটু ভাবিয়া) আচ্ছা, মীনকেতু, তুমি কখনও কাউকে ভালোবেসেছিলে – মনে পড়ে?



মীনকেতু :

(হাসিয়া) চাঁদ কাকে ভালোবাসে কৃষ্ণা?



কৃষ্ণা :

ও কলঙ্কী, ও হয়তো কাউকেই ভালোবাসে না।



মীনকেতু :

(হাততালি দিয়া) ঠিক বলেছ কৃষ্ণা, ওই কলঙ্কীকেই সবাই ভালোবাসে, ও কাউকে ভালোবাসে না!


[গান করিতে করিতে একটি মেয়ের প্রবেশ।]


[গান]


  



মেয়েটি :

কেন ঘুম ভাঙালে প্রিয়



  

              যদি ঠেলিবে পায়ে।।



  

বৃথা বিকশিত কুসুম কি যাবে শুকায়ে।



  

একা বন-কুসুম ছিনু বনে ঘুমায়ে।



  

ছিল পাসরি আপন বেভুল কিশোরী হিয়া



  

বধূর বিধুর যৌবন কেন দিলে জাগায়ে।



  

              প্রিয় গো প্রিয় –



  

আকাশ বাতাস কেন ব্যথার রঙে তুমি



  

              দিলে রাঙায়ে।।



মেয়েটি :

রাজা, কাল রাতে তোমার অনুরাগ দিয়ে আমায় বিকশিত করেছিলে। আমার সেই বিকশিত ফুলের অর্ঘ্য তোমায় দিতে এসেছি। তুমি বলেছিলে ....



মীনকেতু :

(হাসিয়া) সুন্দরী, রাত্রে তোমায় যে-কথা বলেছিলুম, তা রাত্রের জন্যই সত্য ছিল। দিনের আলোকেও তা সত্য হবে এমন কথা তো বলিনি। রাত্রে যখন কাছে ছিলে, তখন তুমি ছিলে কুমুদিনী, আমি ছিলুম চাঁদ। এখন দিন যখন এল, তখন আমি হলুম সূর্য, আমি এখন সূর্যমুখীর, কমলের! যাও! চলে যাও! বিকশিত হয়েছ, এখন সারাদিন চোখ বুঁজে থেকে সন্ধেবেলায় ঝরে পড়ো! যাও!


[ম্লানমুখে দু-হাতে চোখ ঢাকিয়া মেয়েটির প্রস্থান।]



কৃষ্ণা :

(আহত স্বরে) মীনকেতু!



  

(মীনকেতু হো হো করে হেসে উঠল)


  


[গান করিতে করিতে আর একটি মেয়ের প্রবেশ। নাম তার মালা।]


  


[গান]


  



মালা :

চাঁদিনি রাতে কানন-সভাতে আপন হাতে গাঁথিলে মালা।।



  

নিবিড় সুখে সয়েছি বুকে তোমার হাতের সূচির জ্বালা।।



  

        এখনও জাগে লোহিত রাগে



  

             রঙিন গোলাবে তাহারই ব্যথা,



  

        তোমার গলে দুলিব বলে



  

             দিয়েছি কুলে কলঙ্ক কালা।।



  

        যদি ও-গলে নেবে না তুলে



  

             কেন বধিলে ফুলের পরান,



  

        অভিমানে হায় মালা যে শুকায়,



  

             ঝরে ঝরে যায় লাজে নিরালা।।


  



মীনকেতু :

তুমি আবার কে সুন্দরী?



মালা :

সম্রাট, চিনতে পারছ না? আমার নাম মালা! কাল সারারাত যে তোমার গলা জড়িয়ে ছিলুম। আমি ছিলুম কাঁটাবনের ছড়ানো ফুল, তুমি তো আমায় মালা করে সার্থক করেছ!



মীনকেতু :

আঃ, তুমি যদি সার্থকই হয়ে গেলে তবে আবার কেন? এখন তোমার সুতো থেকে একটি একটি করে ফুল ঝরে পড়ুক। ফুল ফুটলে ওকে যেমন মালা গেঁথে সার্থক করতে হয়, তেমনি রাত্রিশেষে সে বাসিমালা ফেলেও দিতে হয়!


  [বুক চাপিয়া ধরিয়া মালার প্রস্থান।]



কৃষ্ণা :

উঃ! আর আমি থাকতে পারছিনে! মীনকেতু! তুমি কী?



মীনকেতু :

হাঁ, ওই ওর নিয়তি। রাত্রের বাসিফুলকে রাত্রিশেষেও যে আঁকড়ে পড়ে থাকে, তার সহায়-সম্বল তো নেই-ই, তার যৌবনও মরে গেছে।



কৃষ্ণা:

নিষ্ঠুর! তোমার কি হৃদয় বলে – মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই?



মীনকেতু :

(হাসিয়া) আমি মনুষ্যত্বের পূজা করি না, কৃষ্ণা! আমি যৌবনের পূজারি! ফুল আর হৃদয় দলে চলাই আমার ধর্ম।



কৃষ্ণা :

তোমায় দেখে বুঝতে পারি মীনকেতু, কেন শাস্ত্রে বলে পাপের দেবতা মারের চেয়ে সুন্দর এ বিশ্বে কেউ নেই।



মীনকেতু :

(হাসিয়া কৃষ্ণার গালে তর্জনী দিয়া মৃদু আঘাত করিতে করিতে) ঠিক বলেছ কৃষ্ণা, মারের চেয়ে, মিথ্যার চেয়ে, মায়ার চেয়ে কি সুন্দর কিছু আছে? চাঁদে কলঙ্ক আছে বলেই তো চাঁদ এত আকর্ষণ করে, তোমার কপালের ওই কালো টিপটাই তো মুখের সমস্ত লাবণ্যকে হার মানিয়েছে। রামধনু মিথ্যা বলেই তো অত সুন্দর! যৌবন ভুল পাপ করে বলেই তো ওর উপর এত লোভ, ও এত সুন্দর!


  


[মুখে চোখে বিলাস-ক্লান্তির চিহ্ন-যুক্তা মদোন্মতা এক নারীর টলিতে টলিতে প্রবেশ।]



[গান]


  



মদালসা :

কেন রঙিন নেশায় মোরে রাঙালে।



  

কেন সহজ ছন্দে যদি ভাঙালে।



  

         শীর্ণ তনুর মোর তটিনীতে কেন



  

         আনিলে ফেনিল জল-উচ্ছ্বাস হেন,



  

         পাতাল-তলের ক্ষুধা মাতাল এ যৌবন



  

                   মদির-পরশে কেন জাগালে।।


  



কৃষ্ণা :

ও কুৎসিত নারীকে এখনই তাড়াও এখান থেকে! ও কে তোমার?



মীনকেতু :

(হাসিয়া) তুমি যে পাপের মিথ্যার কথার কথা বলেছিলে, ও হচ্ছে তারই অপদেবতা! তোমাদের দেবতার মন্দির থেকে ফেরবার পথে ওই অপদেবতাকে দেখলে ওকেও নমস্কার করতে ভুলিনে, কৃষ্ণা! ওর বাঁকা চোখ তোমার সত্যের সোজা চোখের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।



কৃষ্ণা :

উঃ ভগবান! (বসিয়া পড়িল।)



মীনকেতু :

(মেয়েটির দিকে তাকিয়ে) তুমি মদালসা না বসন্তসেনা? ওরই একটা কিছু হবে বুঝি? কিন্তু আজ অতিরিক্ত মদ খেয়েছ এবং অলসও যে হয়েচ তা চলা দেখেই বুঝেছি।



মদালসা :

কী প্রাণ, আজ যে ফুরসতই নেই? (কৃষ্ণাকে দেখে) একে আবার কোথা থেকে আমদানি করলে? আমরা কি চিরকালের জন্যে রপ্তানি হয়ে গেলুম? আচ্ছা, এ রাজ্যি থাকবে না বেশি দিন। দেখি প্রাণ, তখন কার দাঁড়ে গিয়ে যব-ছোলা খাও!



মীনকেতু :

আহা রাগ কর কেন সুন্দরী, মাঝে মাঝে পুণ্য করে পাপেরও মুখ বদলে নিতে হয়, এসব পুণ্যাত্মারা যখন বাসি হয়ে উঠবেন তখন তোমারই দুয়ারে আবার যাব।


  [মদালসার টলিতে টলিতে প্রস্থান।]


  


[প্রধানা গায়িকা কাকলি ও সখীদের গান।]


  


[গান]


  


     কাকলি ও সখীরা :


ধরো ধরো ভরো ভরো এ রঙিন পেয়ালি।


আঁধার এ নিশীথে জ্বালো জ্বালো জ্বালো দেয়ালি।


  চাঁদিনি যবে মলিন প্রখর আলোকে


     প্রদীপ নব জ্বালো গো চোখে,


নতুন নেশা লয়ে জাগো জাগো খেয়ালি।।


ভোলো ভোলো রাতের স্বপন,


প্রভাতে আনো নব জীবন!


শতদলে আঁখিজলে করো গোপন,


হায় বেদনা ভরে কার তরে


        বৃথাই ধেয়ালি।।



মীনকেতু :

ঠিক সময় এসেছ তোমরা কাকলি। তোমার যৌবনের গান আর এদের যৌবনের প্রতীক্ষাই করছিলুম। এই ফুলফোটার গান শুনে বালিকা কিশোরী হয়, তরুণী যৌবন পায়, রাতের কুঁড়ি দিনের ফুল হয়ে হাসে, এই আমার রাজ্যের জাতীয় সংগীত!



কবি :

ঠিক রাজ্যের নয় সম্রাট, এ আমাদের যৌবনের জাতীয় সংগীত।



মীনকেতু :

(কবিকে সুরাপাত্র আগাইয়া দিয়া) নাও কবি, একটু অমৃত পান করে নাও তোমার কণ্ঠে আরও – আরও অমৃত ঝরে পড়ুক। (কৃষ্ণার দিকে চাহিয়া) কিন্তু কৃষ্ণা, তুমি অমন ম্লান মুখে বসে থেকো না। উৎসবের সহস্র প্রদীপের মাঝে একটা প্রদীপও যদি মিটমিট করতে থাকে –



কৃষ্ণা :

(মীনকেতুর মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া) তখন তাকে একেবারে নিবিয়ে দেওয়াই সঙ্গত, সম্রাট!



মীনকেতু :

(সুরার পাত্র কৃষ্ণার দিকে আগাইয়া দিয়া) আমি প্রদীপ নিবাই না কৃষ্ণা, ভালো করে জ্বেলে তুলে তার আলোতে গিয়ে জাঁকিয়ে বসি। এই নাও, একটু স্নেহ-পদার্থ ঢেলে নাও, নিবু নিবু প্রদীপ দপদপ করে জ্বলে উঠবে।



কৃষ্ণা :

(পিছাইয়া গিয়া) আমি দীপশিখা নই সম্রাট, আমি কৃষ্ণা, নিশীথিনী। আর – ও সুধা আপনারাই পান করুন।



কবি :

বোতলকে মাতাল হতে কে দেখেছে কবে, সম্রাট! ওদের যে অন্তরে বাহিরে সুধা, ওদের সুধার দরকার করে না।



মীনকেতু :

না হে কবি, উনি হচ্ছেন, ‘নীলকণ্ঠী’ – শিব তো বলতে পারিনে, শিবা বলব? নাঃ, তাহলে হয়তো এখনই বিশ্রী তান ধরে দেবে। কিন্তু কৃষ্ণা, তুমি যদি নিশীথিনীই হও আমি তো কলঙ্কী চাঁদ। চাঁদ উঠলে তো নিশীথিনীর মুখ অমন মন্ত্র-মুখো হয়ে থাকে না।



কৃষ্ণা :

কিন্তু আজকের এ চাঁদ দ্বিতীয়ার চাঁদ, সম্রাট! এ চাঁদের কিরণে নিশীথিনীর মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে, তা কান্নার চেয়েও করুণ।



কবি :

বাবা, অমন ষোলোকলায় পূর্ণ চাঁদও দ্বিতীয়ার চাঁদ হয়ে গেল!অঃ ওর চৌদ্দটা কলাই বুঝি আজ অন্ধকারে ঢাকা!



কৃষ্ণা :

হাঁ কবি, সময় সময় চাঁদের কলঙ্কটা এমনই বিপুল হয়ে ওঠে! (সম্রাটের দিকে তাকিয়ে) ও কলঙ্ক নয় সম্রাট, ও হচ্ছে দুঃখের পৃথিবীর ছায়া।



মীনকেতু :

অঃ তুমি শুধু নিশীথিনীই নও – তুমি কুয়াশা! এই ক্ষীণ দ্বিতীয়ার চাঁদের জ্যোৎস্নাটুকুকেও মলিন না করে ছাড়বে না! যাক, ওটাও আমার মন্দ লাগে না। সুন্দরের মুখে হাসি যেমন মানায় ও চোখের মরীচিকাও তার চেয়ে কম মানায় না! (দূরে সূর্যোদয়) ওই সূর্য উঠছে, ওই সূর্য – ও যেন দুঃখের, জরার প্রতীক। ওর খরতাপে অশ্রু শুকায়, ফুল ঝরে, তরুণী উষার গালের লালি যায় ম্লান হয়ে, রাতের চাঁদ হয়ে ওঠে দীপ্তিহীন। নাঃ, আজকের মদে জলের ভাগই বোধ হয় বেশি ছিল – নেশাটা ক্রমেই পানসে হয়ে আসছে। কই কবি, তোমার সেনাদল গেল কোথায়?


  


[গান]


  



তরুণীরা :

আধো ধরণি আলো আধো আঁধার।।



  

কে জানে দুখ-নিশি পোহাল কার।।


  



  

আধো কঠিন ধরা, আধেক জল,



  

আধো মৃণাল-কাঁটা আধো কমল,



  

আধো সুর, আধো সুরা, – বিরহ বিহার।।


  



  

আধেক গোপন, আধেক ভাষা!



  

আধো ব্যথিত বুকে আধেক আশা।


  



  

আধো ভালবাসা আধেক হেলা,



  

আধেক সাঁঝ আধো প্রভাত-বেলা,



  

আধো রবির আলো আধো নীহার।।


      [কবি ছাড়া আর সকলের প্রস্থান।]



মীনকেতু :

কবি!



কবি :

যাচ্ছি সম্রাট! আকাশের দেবী ও মাটির মানুষে যখন নিরিবিলি দুটো কথা কওয়ার জন্য মুখ চাওয়া- চাওয়ি করে তখন সব চেয়ে মুশকিল হয় ত্রিশঙ্কুর। লজ্জার দায় এড়াতে বেচারা স্বর্গেও উঠে যেতে পারে না, পৃথিবীতেও নেমে আসতে পারে না!


[প্রস্থান]



মীনকেতু :

(চলে যেতে যেতে ফিরে এসে) যার আগে যাওয়ার কথা, সে-ই যে দাঁড়িয়ে রইল কৃষ্ণা!



কৃষ্ণা :

আমি ভাবছি সম্রাট, এই ফুল দলে চলার কি কোনো জবাবদিহি করতে হবে না কারুর কাছে। এর কি সত্যিই কোনো অপরাধ নেই?



মীনকেতু :

নেই কৃষ্ণা, কোনো অপরাধ নেই। আর যদি থাকেই তা সে অপরাধ আমার নয়, – সে অপরাধ এই চলমান পায়ের, আমার দৃপ্ত গতিবেগের। এই হচ্ছে চির-চঞ্চল যৌবনের চিরকালের রীতি, এই অপরাধে যৌবন যুগে যুগে অপরাধী।


[প্রস্থান]


  



কৃষ্ণা :

(সেইদিকে তাকাইয়া থাকিয়া) নির্মম! দস্যু! (কৃতাঞ্জলিপুটে আকুল কণ্ঠে) তবুও তুমি সুন্দর – অপরূপ। কিন্তু একী! কান্নায় আমার বুক ভেঙে আসছে কেন? ও তো আমার হৃদয়ের কেউ নয়, শুধু এই রাজ্যের রাজা! আমিও ওর কেউ নই। ও সম্রাট, আমি মন্ত্রী। তবু – এমন করে কেন? উঃ! এ কোন্ মায়ামৃগ আমায় ছলনা করতে এল? (মাটিতে লুটাইয়া পড়িল।)


  


[কাকলি আসিয়া নীরবে তাহার মাথায় হাত বুলাইতে লাগিল, কাকলি গান করিতে আরম্ভ করিলে কৃষ্ণা উঠিয়া বসিল।]


  


[গান]


  



কাকলি :

আঁধার রাতে কে গো একেলা।।



  

নয়ন-সলিলে ভাসালে ভেলা।।


  



  

কী দুখে আজি যোগিনী সাজি



  

আপনারে লয়ে এ হেলা ফেলা।।


  



  

সোনার কাঁকন ও দুটি করে



  

হের গো জড়ায়ে মিনতি করে।


  



  

ফেলিয়া ধুলায় দিয়ো না গো তায়



  

         সাধিছে নূপুর চরণ ধরে।


  



  

কাঁদিয়া কারে খোঁজো ওপারে



  

         আজও যে তোমার প্রভাত বেলা।।


  



কৃষ্ণা :

দেখেছিস কাকলি, এই তার দৃপ্ত পদরেখা। (পথ হইতে একটি পদদলিত রাঙা গোলাব তুলিয়া লইয়া) এই তার পায়ে-দলা রক্ত গোলাব, এমনই করে ফুল আর হৃদয় দলে সে তার পায়ের তলার পথ রক্ত-রাঙা করে চলে যায়।



কাকলি :

কেন ভাই, আলেয়ার পিছনে ঘুরে মরছ? হৃদয় দলে চলাই যার ধর্ম, কেন –



কৃষ্ণা :

তুই ভুল বুঝেছিস কাকলি! আমি ওর কথা ভেবে কষ্ট পাই নারী বলে। বন্ধু বলে। তবু ও আলো কেন যেন কেবলই টানতে থাকে। আমি প্রাণপণে বাধা দিই। মাঝে মাঝে হয়তো মনে হয়, ওই মিথ্যার পেছনে ঘোরার চেয়ে বুঝি বড়ো আনন্দ আমার জীবনে আর নেই। হৃদয়ের না হলেও ও তো শৈশবে বন্ধু ছিল। ... আচ্ছা কাকলি, তুই যে গান গাইলি এ কার কাছে শিখেছিস?



কাকলি :

কবি মধুশ্রবার কাছে।



কৃষ্ণা :

কবি মধুশ্রবা! এমন চোখের জলের গান সে লিখলে? সে যে আনন্দের পাখি, সে তো দুঃখ-বেদনাকে স্বীকার করে না! সবাই দেখছি তাহলে আলেয়ার পেছনে ঘুরছে!



কাকলি :

এ কথা আমিও কবিকে বলেছিলুম। সে হেসে বললে, কাঁটার মুখে যে ফুলের সার্থকতা আমি তাকেই দেখি, আমার বুকের তারগুলো ব্যথায় অত টনটন করে ওঠে বলেই তো হাতে এমন বীণা বাজে!



কৃষ্ণা :

(চিন্তিত হইয়া) হুঁ, আমি বুঝেছি কাকলি। কবি এক-একদিন কেমন করে যেন আমার দিকে চায়। (একটু ভাবিয়া) কিন্তু সে তার কথার ঝড়ে মনের কোনো কিছু দাবি করে না, কেবল দিয়েই ওর আনন্দ।



[চন্দ্রকেতুর প্রবেশ]



  

সেনাপতি, তুমি এখানে! তুমি সীমান্ত রক্ষা করতে যাওনি? কাকলি তুই চল, আমি যাচ্ছি।


[কাকলির প্রস্থান]



চন্দ্রকেতু :

তুমি কোন্ সীমান্ত রক্ষার কথা বলছ কৃষ্ণা?



কৃষ্ণা :

তুমি কি জান না, যশলমিরের রানি জয়ন্তী গান্ধার রাজ্য আক্রমণ করেছে?



চন্দ্রকেতু :

জানি কৃষ্ণা শুধু আক্রমণ নয়, আমাদের সীমান্তরক্ষী সেনাদলকে পরাজিত করে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।



কৃষ্ণা :

আমাদের অপরাজেয় সেনাদল পরাজিত হল একজন নারীর হাতে? আর তা জেনেও তুমি আজও রাজধানীতে বসে আছ?



চন্দ্রকেতু :

আমার কর্তব্য আমি জানি কৃষ্ণা। নারীর বিরুদ্ধে আমি অস্ত্রধারণ করিনে। আমার সহকারী সেনাপতিকে পাঠিয়েছি, শুনছি সে-ও নাকি পরাজিত হয়েছে।



কৃষ্ণা :

আমি এ সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, আমি জানতে চাই সেনাপতি, আমাদের অপরাজেয় সেনাদলের এই সর্বপ্রথম পরাজয়ের লজ্জা কার? কে এর জন্য দায়ী?



চন্দ্রকেতু :

তুমি।



কৃষ্ণা :

আমি।



চন্দ্রকেতু :

হাঁ, তুমি! (ব্যথাক্লিষ্ট কণ্ঠে) আমি কোন্ সীমান্ত রক্ষা করব কৃষ্ণা! জয়ন্তী গান্ধার সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত আক্রমণ করেছে, সে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে কতটুকু শক্তি প্রয়োজন? কিন্তু এ হৃদয়ের পূর্ব-সীমান্ত যে আক্রমণ করেছে তার সাথে যে পারিনে।



কৃষ্ণা :

(দৃপ্ত কণ্ঠে) সেনাপতি, আমি শুধু কৃষ্ণা নই, আমি এ সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী।



চন্দ্রকেতু :

জানি কৃষ্ণা! তুমি যখন রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীর আসনে বস, তখন তোমায় অভিবাদন করি, কিন্তু যে তার অন্তরের বেদনার ভারে এই পথের ধূলায় লুটিয়ে পড়ে, তার নাম হতভাগিনি কৃষ্ণা!



কৃষ্ণা :

(চমকিত হইয়া স্নিগ্ধ কণ্ঠে) চন্দ্রকেতু, বন্ধু!



চন্দ্রকেতু :

(আকুল কণ্ঠে) ডাকো কৃষ্ণা, সেনাপতি নয়, বন্ধু নয়, শুধু আমার নাম ধরো ডাকো। তোমার মুখে আমার নাম যেন কত যুগ পরে শুনলাম। আঃ! নিজের নামও নিজের কানে এমন মিষ্টি শুনায়! এমনি করে কৈশোরে তুমি আমার নাম ধরে ডাকতে, আর আমার রক্তে যেন আগুন ধরে যেত।



কৃষ্ণা :

(ম্লান হাসি হাসিয়া) আজও তোমার মনে আছে সে-কথা? আমারও মনে পড়ে চন্দ্রকেতু, একদিন তুমি, আমি আর মীনকেতু এই প্রমোদ-উদ্যানের পথে এক সাথে খেলা করেছি, তখনও রাজার সিংহাসন আর রাজ্যের দায়িত্ব এসে আমাদের আড়াল করে দাঁড়ায়নি। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) তখন কে জানত, এই পথেই আমাদের নতুন করে খেলা শুরু হবে। (একটু ভাবিয়া হাসিয়া) আমি মীনকেতুর পাশে বসে তাকে বলতাম, তুমি রাজা, আমি রানি, ফিরে দেখতাম তুমি ম্লান মুখে চলে যাচ্ছ, আমার চাঁদনি রাত যেন বাদলা মেঘে ছেয়ে ফেলত।



চন্দ্রকেতু :

সত্য বলছ কৃষ্ণা? আমার অশ্রু তোমার চাঁদনি রাতকে মলিন করেছে কোনোদিন তাহলে?



কৃষ্ণা :

করেছে বন্ধু! তুমি আমার বুকে মাধবী রাতের পূর্ণ চাঁদের রূপে উদয় হওনি কোনোদিন, কিন্তু চোখে বাদল রাতের বর্ষাধারা হয়ে নেমেছ।



চন্দ্রকেতু :

(উত্তেজিত কণ্ঠে) ধন্যবাদ কৃষ্ণা! কিন্তু তোমার এও হয়তো মনে আছে যে, আমি শৈশবের সে খেলায় বারবার ম্লানমুখে ফিরেই আসিনি! একদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলুম, তোমার বিরুদ্ধে, তোমার মীনকেতুর বিরুদ্ধে। তোমায় জোর করে ছিনিয়ে নিলুম, মীনকেতু যুদ্ধ করলে, কিন্তু আমার হাতে পরাজিত হল। বিজয়গর্বে উৎফুল্ল হয়ে তোমার দিকে চেয়ে দেখলুম, তুমি কাঁদছ। বুঝলুম, তুমি বিজয়ীকে চাও না – তুমি চাও তাকেই যার কাছে তুমি পরাজিতা লাঞ্ছিতা। তোমায় ফিরিয়া দিলুম তোমার রাজার হাতে।



কৃষ্ণা :

তুমি ভুল করেছ চন্দ্রকেতু! হয়তো সবাই এই ভুল করে। আমি মানি, মীনকেতুকে আমার ভালো লাগে। কিন্তু সে ভালো লাগা ভালোবাসা নয়। সিংহ দেখলে যেমন আনন্দ হয়, ভয় হয়, এও তেমনই। কিন্তু সে কথা থাক, সেদিন তোমার হাতে পরাজিত হয়ে মীনকেতু কী বলেছে, মনে আছে? সে হেসে বলেছিল, “বন্ধু আমি যদি কৃষ্ণাকে তোমার মতো করে চাইতুম, তাহলে আমিও তোমায় এমনি করে পরাজিত করতুম। যাকে চাইনে তার জন্যে যুদ্ধ করতে শক্তি আসবে কোত্থেকে।” সে আরও বলেছিল, “চন্দ্রকেতু, আমি যদি সম্রাট হই, তোমাকে আমার সেনাপতি করব।”



চন্দ্রকেতু :

সেনাপতি আমায় সে করেনি, আমি আমার শক্তিতে সেনাপতি হয়েছি। কিন্তু কৃষ্ণা, কী নিষ্ঠুর তুমি, ও-কথাগুলো তোমার মনে না করিয়ে দিলেও তো চলত।



কৃষ্ণা :

দুঃখ কোরো না বন্ধু, তোমায় বুকের প্রেম দিতে পারিনি বলেই তো চোখের জল দিই। আমি নারী, আমি জানি, হৃদয়হীনতা দিয়ে হৃদয়কে যত আকর্ষণ করা যায়, তার অর্ধেকও হয়তো ভালোবাসা দিয়ে আকর্ষণ করা যায় না। আমি ভালোবাসা পাইনি, তুমিও ভালোবাসা পাওনি – এইখানেই তো আমরা বন্ধু! কিন্তু তুমি তো আমার চেয়েও ভাগ্যবান। আমি যে কাউকে ভালোবাসতেই পারলুম না। তুমি তো তবু একজনকে ভালোবাসতে পেরেছ!



চন্দ্রকেতু :

দোহাই কৃষ্ণা , বন্ধু বোলো না! বোলো না! আমি চাই না তোমার কাছে ওইটুকু। বন্ধু মনের ক্ষুধা মেটাতে পারে, হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতে পারে না। (হাত ধরিয়া) কৃষ্ণা!



কৃষ্ণা :

(ধীরে হাত ছাড়াইয়া লইয়া) কিন্তু তা তো হয় না চন্দ্রকেতু!



[গান করিতে করিতে কাকলির প্রবেশ]


  


[গান]


  



কাকলি :

  



  

যৌবনের যোগিনী আর কতকাল



  

              রবি অভিমানিনী।



  

ফিরে ফিরে গেল কেঁদে মধুযামিনী।।



  

লয়ে ফুলডালি এল বনমালী,



  

জ্বালিল আকাশ তারার দীপালি,



  

ভাঙিল না ধ্যান মন্দির-বাসিনী।।


  



কৃষ্ণা :

আমি চললুম, রাজসভায় যাওয়ার সময় হল, পথ ছেড়ে দাও!



চন্দ্রকেতু :

আমি কোনো দিনই তোমার পথরোধ করে দাঁড়াইনি কৃষ্ণা! আজও দাঁড়াব না। আমি চিরকালের জন্যে তোমার পথ থেকে সরে যাব। কিন্তু যাওয়ার আগে আমার শেষ কথা বলে যাব।



কৃষ্ণা :

কাকলি, তুই চল, আমি যাচ্ছি।


[কাকলির প্রস্থান]



চন্দ্রকেতু :

তুমি জান কৃষ্ণা, আমি জীবনে কোনো যুদ্ধে পরাজিত হইনি। একদিন শৈশবে যেমন জোর করে তোমায় ছিনিয়ে নিয়েছিলুম, ইচ্ছা করলে আজও তেমনি করে ছিনিয়ে নিতে পারি। আমার হাতে সাম্রাজ্য নেই, কিন্তু তরবারি আছে, বাহুতে শক্তি আছে – কিন্তু না – তা নেব না। তোমাকে জয় করেই নেব।



কৃষ্ণা :

যুদ্ধ-জয় আর হৃদয়-জয় সমান সহজ নয় সেনাপতি।



চন্দ্রকেতু :

বেশ কৃষ্ণা, আমিও না-হয় হৃদয়ের ওই রাঙা রণভূমে পরাজিত হয়েই লুটিয়ে পড়ব! কিন্তু সেই পরাজয়ই হবে আমার শ্রেষ্ঠ যুদ্ধজয়। আমি জানি, আজ আমি যেমন করে তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়ছি তুমিও সেদিন পরাজিত-আমার বিদায়-পথের ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে ; কিন্তু সেদিন আমি তোমারই মতো উপেক্ষা করে চলে যাব নিরুদ্দেশের পথে।


[প্রস্থান]



কৃষ্ণা :

(মূঢ়ের মতো সেইদিকে তাকাইয়া আকুল কণ্ঠে) কে আমার নাম রেখেছিল কৃষ্ণা? কৃষ্ণা নিশীথিনীর মতোই আমার এক প্রান্তে সূর্যাস্ত আর এক প্রান্তে পূর্ণ চাঁদের উদয়! না! সূর্যাস্ত কখন হল? – এ কী বলছি?


[রাজসভার সাজে সজ্জিত হইয়া মীনকেতুর প্রবেশ]



মীনকেতু :

সত্যি কৃষ্ণা, কুহেলিকারও একটা আকর্ষণ আছে! আমি রাজসভায় যাচ্ছিলুম, যেতে যেতে তোমার ম্লানমুখ মনে পড়ল। মনে হল এখনও তুমি তেমনি করে বসে আছ। রাজসভা আজ এখানেই আহ্বান করো। সভাসদগণকে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করো।


[অভিবাদন করিয়া কৃষ্ণার প্রস্থান ও রঙ্গনাথের প্রবেশ]



মীনকেতু :

এসো এসো রঙ্গনাথ, বড়ো একা একা ঠেকছিল। তুমি বোধ হয় শুনেছ, আমি আমার এ প্রমোদ-কাননেই আজ রাজসভা আহ্বান করেছি। (হঠাৎ চমকিত হইয়া রুক্ষস্বরে) কিন্তু ও কী রঙ্গনাথ, তুমি আবার দাড়ি রাখতে শুরু করেছ? জানো আমার আদেশ, কেউ দাড়ি রাখলে তাকে কী দণ্ড গ্রহণ করতে হয়? ও কুশ্রী জিনিস রূপকে কলঙ্কিত করে, যৌবনের সভায় ওর স্থান নেই।



রঙ্গনাথ :

জানি সম্রাট, দাড়ি রাখতে চাইলে আমার দেহ আর মাথাটাকে ধরে রাখতে পারবে না। কিন্তু চাঁদের কলঙ্কের মতো দাড়িতে কি মুখের জৌলুস বাড়ে না, সম্রাট? তা ছাড়া কী করি বলুন, আমি তো দাড়ি চাইনে, কিন্তু দাড়ি যে আমায় চায়। ও বুঝি আমার আর-জন্মের পরিত্যক্তা কালো বউ ছিল, তাই এজন্মে দাড়ি-রূপে এসে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিছুতেই গাল ছাড়তে চায় না, যত দূর করে দিই তত সে আঁকড়ে ধরে। তাছাড়া, সম্রাট, আমরা কামাব দাড়ি, আর নাপিত কামাবে পয়সা – এও তো আর সহ্য করতে পারিনে।



মীনকেতু :

(হাসিয়া) আচ্ছা, এবার থেকে আমার নরসুন্দরকে বলে দেব, তোমার কাছে সে পয়সা কামাবে না, দাড়িই কামাবে।



রঙ্গনাথ :

দোহাই সম্রাট! পয়সা কামিয়েই ওরা দাড়ির চেয়ে গালই কামায় বেশি, কিন্তু বিনি-পয়সায় কামান হলে হয়তো গলাটাই কামিয়ে দেবে! আর কৃপা করে যদি পাঠানই, তবে নরসুন্দরকে না পাঠিয়ে ক্ষুরসুন্দর কাউকে পাঠাবেন। ওর ক্ষুর তো নয় যেন খুরপো! সম্রাট একটা গান শুনবেন? গানটা অবশ্য আমার স্ত্রী রচনা করেছেন!



মীনকেতু :

(উচ্চ হাস্য করিয়া) তোমার স্ত্রীর গান? তাও আবার তোমার দাড়ি নিয়ে? গাও, গাও – ও চমৎকার হবে।



রঙ্গনাথ :

সে তো গান নয় সম্রাট – সে শুধু নাকের জল চোখের জল। আমার বড়ো দাড়ির অত্যাচার তার সয়েছিল, কিন্তু কামান দাড়ির খোঁচানি আর সইতে না পেরে বেদনার আনন্দে কবি হয়ে গানই লিখে ফেললে।


[গান]



  

খুঁচি খুঁচি সূচি-সারি



  

হাড়ি মুখে কালো দাড়ি



  

         যেন কন্টক বৈঁচির বনে।



তারে

ছাড়াতে বসন ছিঁড়ে, ক্ষুর ভাঙে রণে।।



দেয়

ভঙ্গ রণে ক্ষুর খুরপো হয়ে



তারে

কাটতে পালায় মাঠে কাস্তে ভয়ে!



সে যে

আঁধার বাদাড়-বন শ্মশ্রুর ঝোপ,



পাশে

গুল্মলতার ঝাড় কন্টক-গোঁফ।



  

(শ্যামের দাড়ি রে – )


শয়নে যাইতে মোর নয়ন ঝুরে লো সই



  

অঙ্গ কাঁপিয়া মরে ডরে। (সখি লো)


ও যে মুখ নয়, পিতামহ ভীষ্ম শুইয়া যেন



  

খর শর-শয্যার পরে! (সখি লো)



  

শজারুর সনে নিতি লড়াই



  

যাই রে দাড়ির বালাই যাই।


শ্যামের দীর্ঘ শ্মশ্রু ছিল যে গো ভালো



  

ছিল না খোঁচার জ্বালা



আমায়

দাড়ির আঙুল বুলায়ে বুলায়ে



  

ঘুম পাড়াইত কালা।



আমার

আবেশে নয়ন মুদে যে যেত!



  

সে পরশে নয়ন বুঁজে যে যেত।



আমি

খড়ের পালুই ধরে শুইতাম যেন গো,



তাহে

শীত নিবারিত, তারে কাটিল সে কেন গো!



শ্যামের

মুখের মতন কে দিল এমন



  

দাড়িরূপী মুড়ো ঝ্যাঁটা গো,


কালার গণ্ড জড়ায়ে কিলবিল করে



  

শত সে সতিন-কাঁটা গো,



  

আমি জ্বলে যে মলাম,


সখী আমায় ধরো ধরো, জ্বলে যে মলাম।।


  


[কৃষ্ণা, মধুশ্রবা, চন্দ্রকেতু, কাকলি, বন্দিনীগণ, ছত্রধারিণী, করঙ্কবাহিনী ও অন্যান্য সভাসদগণের প্রবেশ]


  


[গান]


  



কাকলি ও বন্দিনীগণ :

  



  

জাগো যুবতি। আসে যুবরাজ।।



  

অশোক-রাঙা বসনে সাজ।



  

আসন পাতো বনে অঞ্চল আধ,



  

বন্দনা-গীতি-ভাষা বাধো বাধো,



  

         কপোলে লাজ।।


  



  

উছলি ওঠে যৌবন আকুল তরঙ্গে,



  

খেলিছে অনঙ্গ নয়নে বুকে অঙ্গে



  

         আকুল তরঙ্গে।



  

আগমনি-ছন্দে মেঘ-মৃদঙ্গে,



  

ভবন-শিখী গাহে বন-কুহু সঙ্গে।



  

বাজো হৃদি-অঙ্গনে বাঁশরি বাজো।



[কাকলি ও বন্দিনীগণের প্রস্থান]



চন্দ্রকেতু :

সম্রাট, জয়ন্তী আমাদের সীমান্ত-রক্ষী সেনাদলকে পরাজিত করে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমার সহকারী সেনাপতিকে তার গতিরোধ করতে পাঠিয়েছি। শুনছি সে-ও পরাজিত হয়েছে।



কৃষ্ণা :

কিন্তু আমাদের এ পরাজয়ের অর্ধেক লজ্জা তোমার, সেনাপতি! তুমি নিজে সৈন্য পরিচালন করলে কখনও আমাদের এ পরাজয় ঘটত না।



চন্দ্রকেতু :

তা জানি, কিন্তু আমি নারীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিনে।



মধুশ্রবা :

তুমি জান না সেনাপতি, সব নারী নারী নয়। শৌর্যশালিনী নারীর পরাক্রম যে কোনো পরাক্রমশালী পুরুষের পৌরুষের চেয়েও ভয়ংকর। নদীর জল তরল স্বচ্ছ, কিন্তু সেই জল যখন বন্যার ধারারূপে ছুটে আসে, তখন তার মুখে ঐরাবতও ভেসে যায়।



রঙ্গনাথ :

(অন্যদিকে তাকাইয়া) ঠিক বলেছে বাবা, মদ্দা-মেয়ে পুরুষের বাবা। সেনাপতি যদি একবার আমার স্ত্রীকে দেখতেন, তাহলে বুঝতেন, কেন মায়ের নাম মহিষ-মর্দিনী!



মীনকেতু :

এই কি সেই যশলমিরের প্রবল প্রতাপান্বিত রাজ্যেশ্বরের কন্যা, সেনাপতি? কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম সে উন্মাদিনী। দিবারাত্র নাকি সে রাজস্থানের মরুভূমিতে ঘূর্ণিবায়ুর সাথে নৃত্য করে ফেরে। ওর নাম ওদেশে মরু-নটী।



চন্দ্রকেতু :

হাঁ সম্রাট, এ সেই রহস্যময়ী মরুচারিণী। মরুভূমির দুরন্ত বেদে ও বেদেনির দল এর সহচর-সহচরী, সেনা-সামন্ত – সব। এদের নিয়ে সে মরু-ঝঞ্ঝার মতো পর্বতে প্রান্তরে নৃত্য করে ফেরে।


[অধোমুখে সহকারী সেনাপতির প্রবেশ]



  

একী? সহকারী সেনাপতি? তুমি তাহলে সত্যই পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছ?



সহ-সেনাপতি :

মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় সম্রাট, কিন্তু ও মায়াবিনী। কেমন করে কী হল বুঝতে পারলুম না, যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখলুম আমার ছত্রভঙ্গ সৈন্যদল ঝড়ের মুখে খড়-কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছে। মনে হল, আমাদের ওপর দিয়ে একটা দাবানল বয়ে গেল! ও নারী নয় সম্রাট, ও আগুনের শিখা! ওর সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে পারে – এত শক্তি বুঝি পৃথিবীর কোনো সেনানীরই নেই। সেদিন প্রত্যূষে সে যখন রণক্ষেত্রে এসে দাঁড়াল, মনে হল, সমস্ত আকাশে আগুন ধরে গেছে। আমি মুখ-চোখ কিছুই দেখতে পাইনি, তবু চোখ যেন ঝলসে গেল। সহস্রকিরণ দিনমণির মতো তার সহস্র-শিখা ফণাবিস্তার করে এগিয়ে এল, আমরা ফুৎকারে উড়ে গেলুম।



মীনকেতু :

তোমায় সে বন্দি করলে না সেনাপতি?



সহ-সেনাপতি :

না সম্রাট। আমি তখনও অচেতন অবস্থায় পড়েছিলুম। হঠাৎ কীসের মাতাল করা সৌরভে আমার জ্ঞান ফিরে পেলুম। দেখলুম, সেই বিজয়িনী নারী আমার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে। ভয়ে আমার চক্ষু আপনি মুদে এল। আমি তার দিকে তাকাতে পারলুম না! সে আমায় বললে, তোমায় বন্দি করব না সেনাপতি, তোমার – তোমার সম্রাটকে বন্দি করতে এসেছি।



মীনকেতু :

(উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে) কী বললে সেনানী! আমাকে সে বন্দি করতে এসেছে? কী (সিংহাসন ছাড়িয়া নামিয়া আসিয়া) মন্ত্রী, সেনাপতি, চিনেছি, – চিনেছি আমি এই নারীকে। এরই প্রতীক্ষায় আমার দুর্দান্ত যৌবন কেবলই ফুল আর হৃদয় দলে তার চলার পথ তৈরি করছিল। এরই আগমনের আশায় এত হৃদয়ের এত প্রেম-নিবেদনকে অবহেলা করে চলেছি। ও জয়ন্তী নয়, যশলমিরের অধীশ্বরী নয়, ও মরুচারিণী-মায়াবিনী, চিরকালের চির-বিজয়িনী! সে তার প্রতি চরণ-পাতে শুষ্ক মরুর বুকে মরূদ্যান রচনা করে চলে, পাষাণের বুক ভেঙে অশ্রুর ঝরনাধারা বইয়ে দেয়, পাহাড়ের শুষ্ক হাড়ে নিত্য-নতুন ফুল ফোঁটায় – এ সেই নারী। মন্ত্রী, সেনাপতি, সভাসদগণ! আমার অপরাজেয় সৈন্যদলের এই প্রথম পরাজয় – নারীর হাতে, সুন্দরের হাতে, এ আমারই পরাজয়, তোমাদের সম্রাটের পরাজয়, যৌবনের রাজার পরাজয়। এখনই ঘোষণা করে দাও, আমার সাম্রাজ্য জুড়ে উৎসব চলুক, আনন্দের সহস্র দীপালি জ্বলে উঠুক! বলে দাও, আজ তাদের রাজাকে পরাজিত করে তাদের রাজলক্ষ্মী সাম্রাজ্যে প্রবেশ করছে। আমার এই রাজসভা এখনই উৎসব-প্রাঙ্গণে পরিণত হোক। কবি, নিয়ে এসো তোমার বেণু, বীণা, সুরা ও নর্তকীর দল। আজ যৌবনের এই প্রথম পরাজয়ের পরম ক্ষণকে বরণ করতে যেন হাসি, গান, আনন্দের এতটুকু কার্পণ্য না করি! কৃষ্ণা, তুমি অমন ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে কেন? তোমাদের রাজ্যের বিজয়িনী রাজলক্ষ্মীকে অভ্যর্থনা করে আনার দায়িত্ব যে তোমারই। আনন্দ করো, আনন্দ করো!




সভাসদগণ :

জয়, গান্ধার-সাম্রাজ্যের ভাবী রাজলক্ষ্মীর জয়!



কৃষ্ণা :

মার্জনা করবেন সম্রাট। আমি যদি সত্য সত্যই এই সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হই, তাহলে আদেশ দিন, আমি সে বিজয়িনীর গতিরোধ করব। আমি নারী, নারী কোন্ শক্তিতে যুদ্ধে জয়ী হয়, তা আমি জানি। ওর মায়ায় আপনার তরুণ সেনাপতিদের চোখ ঝলসে যেতে পারে, তারা পরাজিত হতে পারে, ওরা পুরুষ, কিন্তু আমি তার অভিযানের ঔদ্ধত্যের শাস্তিদান করব।



মীনকেতু :

পারবে না কৃষ্ণা, পারবে না। যে নারী আমার সীমান্তের দুর্ভেদ্য দুর্গ-প্রাকারের বাধাকে অতিক্রম করে আমার চির-বিজয়ী সেনাদলকে এমন পরাস্ত করেছে, সে সামান্যা নারী নয়, সে চিরকালের বিজয়িনী।



কৃষ্ণা :

সে যদি সম্রাটের মনের দুর্ভেদ্য পাষাণ-প্রাচীর অতিক্রম করে হৃদয়-সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে থাকে তো, স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু তবু সেই বিজয়িনীর সাথে আমার শক্তি-পরীক্ষার কোনো অধিকারিই কি নেই, সম্রাট?



মীনকেতু :

নিশ্চয় আছে, কৃষ্ণা। আমি আদেশ দিলুম তুমি যেতে পার তার শক্তি-পরীক্ষায়।



চন্দ্রকেতু :

সেনাপতি জীবিত থাকতে মন্ত্রীর সৈন্য পরিচালনার চেয়ে আমাদের বড়ো কলঙ্ক আর কি থাকতে পারে সম্রাট? মন্ত্রী রাজ্যই পরিচালনা করেন, সৈন্যদল চালনা করা সেনাপতির কাজ।



কৃষ্ণা :

(সক্রোধে ও বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে) চুপ করো সেনাপতি। তুমি আজ হীন-বীর্য কাপুরুষ, তোমার শক্তি থাকলে আমাদের অজেয় সেনাদলের এই হীন পরাজয় ঘটত না।



চন্দ্রকেতু :

কাপুরুষই যদি হয়ে থাকি সে অপরাধ আমি ছাড়া হয়তো আর কারুর।



মীনকেতু :

ঠিক বলেছ চন্দ্রকেতু। মাঝে মাঝে অটল পৌরুষের মহিমাও খর্ব হয়, বিজয়ীর রথের চূড়ায় নীলাম্বরীর আঁচল দুলে ওঠে বলেই তো পৃথিবী আজও সুন্দর! তুমি যে কারণে কাপুরুষের আখ্যা পেলে, ঠিক সেই কারণেই হয়তো আমারও বজ্রমুষ্টি শিথিল হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই তরবারি ধারণ করতে পারছিনে।



চন্দ্রকেতু :

আমি এখনও নিজেকে তত দুর্বল মনে করিনে, সম্রাট। যদি শক্তিই হারিয়ে থাকি, তাহলেও যে-শক্তি এখনও বাহুতে অবশিষ্ট আছে, পৃথিবী জয়ের জন্য সেই শক্তিকেই যথেষ্ট মনে করি। (প্রস্থানোদ্যত) আমি কি কোনো যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি, সম্রাট?



মীনকেতু :

না সেনাপতি। তুমি যে আমার দক্ষিণ হস্তের তরবারি। কিন্তু সেনাপতি, আজ যে আমারই তরবারি-মুষ্টি শিথিল হয়ে গেছে, তুমি শক্তি পাবে কোত্থেকে? তুমি এতদিন অস্ত্রের যুদ্ধে, নর-সংগ্রামেই বিজয়ী হয়েছ,, কিন্তু হৃদয়ের যুদ্ধে নারীকে জয় করার সংগ্রামেও জয়ী হয়ে ফেরা, সে তোমার চেয়ে শতগুণে শক্তিধর বীরপুরুষরাও পারেনি, বন্ধু!



চন্দ্রকেতু :

এ তো আমার হৃদয়-জয়ের অভিযান নয়, সম্রাট, এ অভিযান শুধু যুদ্ধ-জয়ের জন্য, সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য।



মীনকেতু :

(একবার কৃষ্ণা ও একবার চন্দ্রকেতুর দিকে তাকাইয়া চতুর হাসি হাসিয়া) এইখানেই তো রহস্য চন্দ্রকেতু। যেখানে আসল যুদ্ধ চলেছে সেনাপতির, সে রণক্ষেত্র ছেড়ে সে যদি এক শূন্যমাঠে গিয়ে তরবারি ঘোরায় তাহলে তার জয়ের আশাটা বেশ একটু মহার্ঘ হয়ে পড়ে না কি?



চন্দ্রকেতু :

আজ তারই পরীক্ষা হোক সম্রাট। আমি দেখতে চাই সত্যই আমি শক্তি হারিয়েছি কি না।


  


[প্রস্থান]



কৃষ্ণা :

আপনার আনন্দ-উৎসব চলুক সম্রাট, আমি কৃষ্ণা – আলোক-সভার অন্তরালেই আমার চিরকালের স্থান।


  


[প্রস্থান]


  


[সহসা আকাশ অন্ধকার করিয়া কাল-বৈশাখীর মেঘ দেখা দিল। ধুলায় শুকনো পাতায় প্রমোদ-উদ্যান ছাইয়া ফেলিল। মেঘের ঘন গর্জনে দিগন্ত কাঁপিয়া উঠিল।]


  



রঙ্গনাথ :

(সভয়ে চিৎকার করিয়া) সম্রাট! আকাশে দেবতাদের উৎসবের ঘন্টা বেজে উঠেছে! অপ-দেবতার আয়োজন পণ্ড করতেই ব্যাটাদের এই কুমন্ত্রণা। বাবা, “যঃ পলায়তি স জীবতি!”



মীনকেতু :

(হাসিয়া) ভয় নেই রঙ্গনাথ! ওই ঝড়ই আমার না-আসা বন্ধুর পদধ্বনি। শুনছ না – বজ্রে বজ্রে তার জয়ধ্বনি, কালবৈশাখীর মেঘে তার বিজয়-পতাকা? চলো প্রাসাদের অলিন্দে বসে আজ মেঘ-বাদলেরই নৃত্যোৎসব দেখি গিয়ে।



[নৃত্য ও গান করিতে করিতে ঝেড়ো-হাওয়া ও ঘূর্ণির প্রবেশ]


  


[গান]


  



ঝোড়ো-হাওয়া :

ঝরনার ঝাঁঝর বাজে ঝন ঝন।



  

বনানী-কুন্তল এলাইয়া ধরণি কাঁদিছে



  

             পড়ি চরণে শন শন শন শন।।



  

দোলে ধূলি-গৈরিক নিশান গগনে,



  

ঝামর কেশে নাচে ধূর্জটি সঘনে,



  

হর-তপোভঙ্গের ভুজঙ্গ নয়নে,



  

সিন্ধুর মঞ্জীর চরণে বাজে রণ রণ রণ রণ।।


  



ঘূর্ণি :

লীলা-সাথি তব নেচে চলি ঘূর্ণি।।



  

বালুকার ঘাগরি, ঝরা পাতা উড়নি।।



  

আলুথালু শতদলে খোঁপা ফেলি টানি;



  

দিকে দিকে ঝরনার কুলুকুলু হানি।



  

সলিলে নুড়িতে নুড়ি পঁইচি বাজে



  

             রিনিঝিনি রণঝন।।


  


[গান করিতে করিতে ঝড় ও ঘূর্ণির প্রস্থান]


[মৃদঙ্গের তালে তালে নাচিতে নাচিতে নটরাজের প্রবেশ]


  


[গান]


  



নটরাজ :

নাচিছে নটনাথ শংকর মহাকাল



  

লুটাইয়া পড়ে দিবারাত্রির বাঘ-ছাল,



  

            আলো-ছায়ার বাঘ-ছাল,



  

ফেনাইয়া ওঠে নীল কণ্ঠের হলাহল



  

ছিঁড়ে পড়ে দামিনী অগ্নি-নাগিনী দল।



  

দোলে ঈশান-মেঘে ধূর্জটি-জটাজাল।।


  



  

বিষম-ছন্দে বোলে ডমরু নৃত্য-বেগে



  

ললাট-বহ্নি দোলে প্রলয়ানন্দে জেগে।।



  

চরণ-আঘাত লেগে জাগে শ্মশানে কঙ্কাল।।


  



  

সে নৃত্য-ভঙ্গে গঙ্গা-তরঙ্গে



  

সংগীত দুলে ওঠে অপরূপ রঙ্গে,



  

নৃত্য-উছল জলে বাজে জলদ তাল।।


  



  

সে নৃত্য-ঘোরে ধ্যান নিমীলিত ত্রি-নয়ন



  

ধ্বংসের মাঝে হেরে নব সৃজন-স্বপন,



  

জ্যোৎস্না-আশিস ঝরে উছলিয়া শশী-থাল।।


  


[নৃত্য ও গান করিতে করিতে বৃষ্টিধারার প্রবেশ]


  


[গান]


  



বৃষ্টিধারা :

            নামিল বাদল



  

রুমু রুমু ঝুমু নূপুর চরণে



  

চল লো বাদল-পরি আকাশ-আঙিনা ভরি



  

            নৃত্য-উছল।।



  

চামেলি কদম যূথী মুঠি মুঠি ছড়ায়ে



  

উতল পবনে দে অঞ্চল উড়ায়ে



  

তৃষিত চাতক-তৃষ্ণারে জুড়ায়ে



  

            চল ধরাতল।।

Interested for our works and services?
Get more of our update !