Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Sunday, November 27, 2016

চির-জনমের প্রিয়া

চির-জনমের প্রিয়া


আরও কতদিন বাকি?


বক্ষে পাওয়ার আগে বুঝি, হায়, নিভে যায় মোর আঁখি!


অনন্তলোকে অনন্তরূপে কেঁদেছি তোমার লাগি


সেই আঁখিগুলি তারা হয়ে আজও আকাশে রয়েছে জাগি।


চির-জনমের প্রিয়া মোর! চেয়ে দেখো নীলাকাশে


ভ্রমরের মতো ঝাঁক বেঁধে কোটি গ্রহ-তারা ছুটে আসে


তোমার শ্রীমুখ-কমলের পানে! ওরা যে ভুলিতে নারে


আজিও খুঁজিয়া ফিরিছে তোমায় অসীম অন্ধকারে!


বারে বারে মোর জীবন-প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে, প্রিয়া।


নেভেনি আমার নয়ন, তোমারে দেখিবার আশা নিয়া।


আমি মরিয়াছি, মরেনি নয়ন ; দেখো প্রিয়তমা চাহি


তব নাম লয়ে ওরা কাঁদে আজও – ওদের নিদ্রা নাহি।


ওরা তারা নয়, অভিশপ্ত এ বিরহীর ওরা আঁখি,


মহাব্যোম জুড়ে উড়িয়া বেড়ায় আশ্রয়হারা পাখি!


আঁখির আমার ভাগ্য ভালো গো, পেয়েছিল আঁখি-জল,


তাই আজও তারা অমর হইয়া ভরে আছে নভোতল!


বাহু দিয়া মোর কন্ঠ যদি গো জড়াইতে কোনদিন,


আঁখির মতন এই দেহ মোর হইত মৃত্যুহীন!


তোমার অধর নিঙাড়িয়া মধু পান করিতাম যদি,


আমার কাব্যে, সংগীতে, সুরে বহিত অমৃত-নদী!


  


*        *        *


ফুল কেন এত ভালো লাগে তব, কারণ জান কি তার?


ওরা যে আমার কোটি জনমের ছিন্ন অশ্রুহার!


যত লোকে আমি তোমার বিরহে ফেলেছি অশ্রুজল,


ফুল হয়ে সেই অশ্রু – ছুঁইতে চাহে তব পদতল!


অশ্রুতে মোর গভীর গোপন অভিমান ছিল হায়,


তাই অভিমানে তোমারে ছুঁইয়া ফুল শুকাইয়া যায়!


ঝরা ফুল লয়ে বক্ষে জড়ায়ে ধরেছ কি কোনোদিন?


এত সুন্দর, তবু কেন ফুল এমন ব্যথা-মলিন?


তব মুখ পানে চেয়ে থাকে ফুল মোর অশ্রুর মতো;


তোমারে হেরিয়া উহাদের গত জনমের স্মৃতি যত


জেগে ওঠে প্রাণে! তাই অভিমানে ঝরে সে সন্ধ্যাবেলা,


ভুলিতে পারে না, যুগে যুগে তুমি হানিয়াছ যত হেলা!


  


*        *        *


পূর্ণিমা চাঁদ দেখেছ? দেখেছ তার বুকে কালো দাগ!


ওর বুকে ক্ষত-চিহ্ন এঁকেছে, জান, কার অনুরাগ?


কোটি জনমের অপূর্ণ মোর সাধ-আশা জমে জমে


চাঁদ হয়ে হায় ভাসিয়া বেড়ায় নিরাশার মহাব্যোমে!


কলঙ্ক হয়ে বুকে দোলে তার তোমার স্মৃতির ছায়া,


এত জ্যোৎস্নায় ঢাকিতে পারেনি তোমার মধু মায়া!


কোন সে অতীতে মহাসিন্ধুর মন্থন শেষে, প্রিয়া,


বেদনা-সাগরে চাঁদ হয়ে উঠে তোমারে বক্ষে নিয়া!


পালাইতে ছিনু সুদূর শূন্যে! নিঠুর বিধাতা পথে


তোমারে ছিনিয়া লয়ে গেল হায় আমার বক্ষ হতে!


তুমি চলে গেলে, বুকে রয়ে গেল তব অঙ্গের ছাপ,


শূন্য বক্ষে শূন্যে ঘুরি গো, চাঁদ নয় অভিশাপ!


  


*        *        *


প্রাণহীন দেহ আকাশে ফেলিয়া ধরণিতে আসি ফিরে,


তোমারে খুঁজিয়া বেড়াই গোমতী পদ্মা যমুনা তীরে!


চিনি যবে হায় গোধূলিবেলায় শুভ লগ্নের ক্ষণে,


বাঁশি না বাজিতে লগ্ন ফুরায়, আঁধার ঘনায় বনে!


তুমি চলো যাও ভবনের বধূ, আমি যাই বনপথে,


মোর জীবনের মরা ফুল তুলে দিই মরণের রথে!


  


*        *        *


শ্রাবণ-নিশীথে ঝড়ের কাঁদন শুনেছ কি কোনোদিন?


কার অশান্ত অসহ রোদন আজও শ্রান্তহীন


দিগ্‌দিগন্তে দস্যুর মতো হানা দিয়ে ফেরে হায়!


ভবনে ভবনে কার বুক থেকে কাহারে ছিনিতে চায়? –


এমনই সেদিন উঠেছিল ঝড় মহাপ্রলয়ের বেশে


যেদিন আমারে পথে ফেলে গেলে চলিয়া নিরুদ্দেশে!


প্রবল হস্তে নাড়া দিয়া আমি অসীম শূন্য নভে


কৃষ্ণ মেঘের ঢেউ তুলেছিনু ; গর্জিয়া ভীম রবে


বিশ্বের ঘুম ভেঙে দিয়েছিনু! যেখানে যে ছিল সুখে


যেখানে প্রিয় ও প্রিয়া ছিল – সেথা বজ্র হেনেছি বুকে!


ঝড়ের বাতাসে আমার নিশাসে নড়িল না মহাকাল,


মোর ধূমায়িত অশ্রু-বাষ্প রচিল জলদ-জাল।


অঝোর ধারায় ঝরিনু ধরায় খুঁজিলাম বনভূমি


ফুরাইল আয়ু, থির হল বায়ু, সাড়া দিলে নাকো তুমি!


আমার ক্ষুধিত সেই প্রেম আজও বিজলি-প্রদীপ জ্বেলে


অন্ধ আকাশ হাতড়িয়া ফেরে ঝঞ্ঝার পাখা মেলে!


তুমি বেঁচে গেছ, অতীতের স্মৃতি ভুলিয়াছ একেবারে,


নইলে ভুলিয়া ভয় – ছুটে যেতে মরণের অভিসারে!


  


*        *        *


শান্ত হইনু প্রলয়ের ঝড়, মলয়-সমীর রূপে


যেখানে দেখেছি ফুল সেইখানে ছুটে গেছি চুপে চুপে।


পৃথিবীতে যত ফুটিয়াছে ফুল সকল ফুলের মুখে


তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরেছি – না পেয়ে উগ্র দুখে


ঝরায়েছি ফুল ধরার ধুলায়! জরা ফুল-রেণু মেখে


উদাসীন হাওয়া ফিরিয়াছি পথে তব প্রিয় নাম ডেকে!


সদ্য-স্নাতা এল কুন্তল শুকাইতে যবে তুমি


সেই এলোকেশ বক্ষে জড়ায়ে গোপনে যেতাম চুমি!


তোমার কেশের সুরভি লইয়া দিয়াছি ফুলের বুকে


আঁচল ছুঁইয়া মূর্ছিত হয়ে পড়েছি পরম সুখে!


তোমার মুখের মদির সুরভি পিইয়া নেশায় মাতি


মহুয়া বকুল বনে কাটায়েছি চৈতি চাঁদিনি রাতি।


তব হাত দুটি লতায়ে রহিত পুষ্পিতা লতা সম


কত সাধ যেত যদি গো জড়াত ও লতা কন্ঠে মম!


তব কঙ্কণ চুড়ি লয়ে আমি খেলেছি, দেখনি তুমি,


চলিতে মাথার কাঁটা পড়ে যেত, আমি তুলিতাম চুমি!


চোরের মতন চুরি করিয়াছি তব কবরীর ফুল!–


সে সব অতীত জনমের কথা – আজ মনে হয় ভুল!


  


*        *        *


আজ মুখপানে চেয়ে দেখি, তব মুখে সেই মধু আছে,


আজও বিরহের ছায়া দোলে তব চোখের কোলের কাছে!


ডাগর নয়নে আজও পড়ে সেই সাগর জলের ছায়া,


তনুর অণুতে অণুতে আজিও সেই অপরূপ মায়া!


আজও মোর পানে চাহ যবে, বুকে ঘন শিহরন জাগে,


আমার হৃদয়ে কোটি শতদল ফুটে ওঠে অনুরাগে


আজও যবে চাও, আমার ভুবনে ওঠে রোদনের বাণী,


কানাকানি করে চাঁদে ও তারাতে –‘জানি গো তোমারে জানি!’


রুধিরে আমার নূপুর বাজে গো, কহে – ‘প্রিয়া, চিনি, চিনি’!


একদিন ছিলে প্রেমের গোলোকে মোর প্রেম-গরবিনি।


ছিল একদিন – আমার সোহাগে গলিয়া যমুনা হতে


নিবেদিত নীল পদ্মের মতো ভাসিতে প্রেমের স্রোতে!


ভাসিতে ভাসিতে আসিয়াছ আজ এই পৃথিবীর ঘাটে,


         আমি    পুষ্প-বিহীন শূন্যবৃন্ত কাঁটা লয়ে দিন কাটে!


  


*        *        *


মনে করো, যেন সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা।


তুমি রয়ে গেলে এপারে, ভাসিল ওপারে আমার ভেলা!


সেই নদীজলে পড়ে গেলে তুমি ফুলের মতন ঝরে,


কেঁদে বলেছিলে যাবার বেলায় – ‘মনে কি পড়িবে মোরে,


জনমিবে যবে আর কি আঁকিবে হৃদয়ে আমার ছবি।’


আমি বলেছিনু, ‘উত্তর দেবে আর জনমের কবি!’


সেই বিরহীর প্রতিশ্রুতি গো আসিয়াছি কবি হয়ে,


ছবি আঁকি তব আমার বুকের রক্ত ও আয়ু লয়ে!


ঝাঁকে ঝাঁকে মোর কথার কপোত দিকে দিকে যায় ছুটে


হংস-দূতীর মতো মোর লিপি ধরিয়া চঞ্চুপুটে!


হারায়ে গিয়াছে শূন্যে তাহারা ফিরিয়া আসেনি আর,


তাই সুরে সুরে বিধূনিত করি অসীম অন্ধকার!


ভবনে ভবনে সেই সুর প্রতি কন্ঠ জড়ায়ে কহে–


‘যাহারে খুঁজিয়া কাঁদি নিশিদিন, জান সে কোথায় রহে?’


তারা মরে, ফুল ঝরে সেই সুরে, তুমি শুধু কাঁদিলে না


আমার সুরের পালক কুড়ায়ে কবরীতে বাঁধিলে না!


আমার সুরের ইন্দ্রাণী ওগো! ব্যথার সাগর-তলে–


দেখেছি কি কত না-বলা কথার মুক্তা মানিক জ্বলে?


তোমার কন্ঠে মালা হয়ে তারা মুক্তি লভিতে চায়


গত জনমের অস্থি আমার নিদারুণ বেদনায়


মুক্তা হয়েছে; অঞ্জলি দিতে তাই গাঁথি গানে গানে


চরণে দলিয়া ফেলে দিয়ো পথে যদি তা বেদনা হানে।


মনে করো, দুঃস্বপ্নের মতো আমি এসেছিনু রাতে


বহুবার গেছ ভুলিয়া এবারও ভুলিয়া যাইয়ো প্রাতে


কহিলাম যত কথা প্রিয়তমা মনে কোরো সব মায়া,


সাহারা মরুর বুকে পড়ে না গো শীতল মেঘের ছায়া!


মরুভূর তৃষা মিটাইবে তুমি কোথা পাবে এত জল?


বাঁচিয়া থাকুক আমার রৌদ্রদগ্ধ আকাশতল!

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !