Search This Blog

Theme images by MichaelJay. Powered by Blogger.

Blog Archive

Sunday, November 27, 2016

মহাত্মাজি

ওগো ও কর্ণফুলী,


উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।


যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা,


আমার অশ্রু লাগিবে না সখী তার চেয়ে বেশি লোনা!


তুমি শুধু জল করো টলমল ; নাই তব প্রয়োজন


আমার দু-ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।


যুগ যুগ ধরি বাড়াইয়া বাহু তব দু-ধারের তীর


ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে, তব জল-মঞ্জীর


বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে!


কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে!


তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তারাই পেল না কূল,


দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দুদিনের বুলবুল?


– বুঝি প্রিয় সব বুঝি,


তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখিরে তাহার খুঁজি!


  


        *          *          *


  


তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভোলে যাওয়া ভাগিরথী –


তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতী?


দেশে দেশে ঘুরে পেয়েছি কি দেখা মিলনের মোহানায়,


স্থলের অশ্রু নিশেষ হইয়া যথায় ফুরায়ে যায়?


ওরে পার্বতী উদাসিনী, বল এ গৃহ-হারারে বল,


এই স্রোত তোর কোন পাহাড়ের হাড়-গলা আঁখি-জল?


বজ্র যাহারে বিঁধিতে পারেনি, উড়াতে পারেনি ঝড়,


ভূমিকম্পে যে টলেনি, করেনি মহাকালেরে যে ডর,


সেই পাহাড়ের পাষাণের তলে ছিল এত অভিমান?


এত কাঁদে তবু শুকায় না তার চোখের জলের বান?


তুই নারী, তুই বুঝিবি না নদী পাষাণ নরের ক্লেশ,


নারী কাঁদে – তার সে-আঁখিজলের একদিন শেষ।


পাষাণ ফাটিয়া যদি কোনোদিন জলের উৎস বহে,


সে জলের ধারা শাশ্বত হয়ে রহে রে চির-বিরহে!


নারীর অশ্রু নয়নের শুধু ; পুরুষের আঁখি-জল


বাহিরায় গলে অন্তর হতে অন্তরতম তল!


আকাশের মতো তোমাদের চোখে সহসা বাদল নেমে


রৌদ্রের তাত ফুটে ওঠে সখী নিমেষে সে মেঘ থেমে!


  


        *         *        *


  


–ওগো ও কর্ণফুলী!


তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি?


তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে,


‘সাম্পান’-নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?


আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান-ফুল গেল খুলি,


সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী ?


  


যে গিরি গলিয়া তুমি বও নদী, সেথা কি আজিও রহি


কাঁদিছে বন্দী চিত্রকূটের যক্ষ চির-বিরহী?


তব এত জল একি তারই সেই মেঘদূত-গলা বাণী?


তুমি কি গো তার প্রিয়-বিরহের বিধুর স্মরণখানি?


ওই পাহাড়ে কি শরীরে স্মরিয়া ফারেসের ফরহাদ,


আজিও পাথর কাটিয়া করিছে জিন্দেগি বরবাদ?


সারা গিরি হল শিরী-মুখ হায়, পাহাড় গলিল প্রেমে,


গলিল না শিরী! সেই বেদনা কি নদী হয়ে এলে নেমে?


ওই গিরি-শিরে মজনুন কি গো আজিও দিওয়ানা হয়ে


লায়লির লাগি নিশিদিন জাগি ফিরিতেছে রোয়ে রোয়ে?


পাহাড়ের বুক বেয়ে সেই জল বহিতেছ তুমি কি গো? –


দুষ্মন্তের খোঁজ-আসা তুমি শকুন্তলার মৃগ?


মহাশ্বেতা কি বসিয়াছে সেথা পুণ্ডরীকের ধ্যানে? –


তুমি কি চলেছ তাহারই সে প্রেম নিরুদ্দেশের পানে? –


যুগে যুগে আমি হারায়ে প্রিয়ারে ধরণির কূলে কূলে


কাঁদিয়াছি যত, সে অশ্রু কি গো তোমাতে উঠেছে দুলে?


  


      *          *          *


  


– ওগো চির উদাসিনী!


তুমি শোনো শুধু তোমারই নিজের বক্ষের রিনিরিনি।


তব টানে ভেসে আসিল যে লয়ে ভাঙা ‘সাম্পান’ তরি,


চাহনি তাহার মুখ-পানে তুমি কখনও করুণা করি।


জোয়ারে সিন্ধু ঠেলে দেয় ফেলে তবু নিতি ভাটি-টানে


ফিরে ফিরে যাও মলিন বয়ানে সেই সিন্ধুরই পানে!


বন্ধু, হৃদয় এমনই অবুঝ কারও সে অধীন নয়!


যারে চায় শুধু তাহারেই চায়– নাহি মনে লাজ ভয়।


বারে বারে যায় তারই দরজায়, বারে বারে ফিরে আসে!


যে আগুনে পুড়ে মরে পতঙ্গ – ঘোরে সে তাহারই পাশে!


তব জলে আমি ডুবে মরি যদি, নহে তব অপরাধ,


তোমার সলিলে মরিব ডুবিয়া, আমারই সে চির-সাধ!‌


আপনার জ্বালা মিটাতে এসেছি তোমার শীতল তলে,


তোমারে বেদনা হানিতে আসিনি আমার চোখের জলে!


অপরাধ শুধু হৃদয়ের সখী, অপরাধ কারও নয়!


ডুবিতে যে আসে ডুবে সে একাই, তটিনী তেমনই বয়!


  


      *        *        *


  


সারিয়া এসেছি আমার জীবনে কূলে ছিল যত কাজ,


এসেছি তোমার শীতল নিতলে জুড়াইতে তাই আজ!


ডাকনিকো তুমি, আপনার ডাকে আপনি এসেছি আমি


যে বুকের ডাক শুনেছি শয়নে স্বপনে দিবস-যামি।


হয়তো আমারে লয়ে অন্যের আজও প্রয়োজন আছে,


মোর প্রয়োজন ফুরাইয়া গেছে চিরতরে মোর কাছে!


– সে কবে বাঁচিতে চায়,


জীবনের সব প্রয়োজন যার জীবনে ফুরায়ে যায়!


  


জীবন ভরিয়া মিটায়েছি শুধু অপরের প্রয়োজন,


সবার খোরাক জোগায়ে নেহারি উপবাসী মোরই মন!


আপনার পানে ফিরে দেখি আজ – চলিয়া গেছে সময়,


যা হারাবার তা হারাইয়া গেছে, তাহা ফিরিবার নয়!


হারায়েছি সব, বাকি আছি আমি, শুধু সেইটুকু লয়ে


বাঁচিতে পারিনা, যত চলি পথে তত উঠি বোঝা হয়ে!


  


বহিতে পারি না আর এই বোঝা, নামানু সে ভার হেথা;


তোমার জলের লিখনে লিখিনু আমার গোপন ব্যথা!


ভয় নাই প্রিয়, নিমেষে মুছিয়া যাইবে এ জল-লেখা,


তুমি জল – হেথা দাগ কেটে কভু থাকে না কিছুরই রেখা!


আমার ব্যথায় শুকায়ে যাবে না তব জল কাল হতে,


ঘূর্ণাবর্ত জাগিবে না তব অগাধ গভীর স্রোতে।


হয়তো ঈষৎ উঠিবে দুলিয়া, তারপর উদাসিনী,


বহিয়া চলিবে তব পথে তুমি বাজাইয়া কিঙ্কিণি!


শুধু লীলাভরে তেমনই হয়তো ভাঙিয়া চলিবে কূল,


তুমি রবে, শুধু রবে নাকো আর এ গানের বুলবুল!


  


তুষার-হৃদয় অকরুণা ওগো, বুঝিয়াছি আমি আজি –


দেওলিয়া হয়ে কেন তব তীরে কাঁদে ‘সাম্পান’-মাঝি!

No comments:
Write comments

Interested for our works and services?
Get more of our update !